ॐ सभा-য় আপনাদের জানাই স্বাগতম <> Facebook Page www.facebook.com/omsabha <> Facebook Group www.facebook.com/groups/OmSabha <> Blog,Page,Group থেকে বিনা অনুমতিতে লেখা নিলে আইনত অপরাধ বলে গণ্য হবে। <> সকল স্বত্ব ॐ सभा -র দ্বারা সংরক্ষিত ।

Tuesday, November 13, 2012

কালী



কালী

যে কাল সর্ব জীবের গ্রাসকারী , সেই কালেরও যিনি গ্রাসকারীনি , মহানির্বাণ তন্ত্র বলেন তিনিই কালী – আদ্যাশক্তি । 

কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীত্তিরত । 
মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা ।


কাল নির্মম সত্য , কিন্তু তাই বলে চূড়ান্ত সত্য নয় । কালেরও নিয়ন্ত্রী শক্তি আছে । কালশক্তির প্রভাবেই জগতের উৎপত্তি ও স্থিতি । মহাপ্রলয়ে সেই মহাকালই আবার সমগ্র সৃষ্টিকে গ্রাস করছেন । কিন্তু মনে রাখতে হবে , এমন যে মহাকাল , সেও পরিণামের অধীন । মহাপ্রলয়ে কালশক্তি মহাকালীর ভিতরেই নিঃশেষে লীন হয়ে যায় । 

রামপ্রসাদের ভাষায় 
“ কালের কাল মহাকাল 
সে কাল মায়ের পদানত ।”


কালী তন্ত্রের উক্তি 
“ কালনিয়ন্ত্রাৎ কালী তত্ত্বজ্ঞানপ্রদায়িনী ।”
                                   
                                     
আদ্যাশক্তি 

মহানির্বাণ তন্ত্র বলেছেন কালী আদ্যাশক্তি । কারন কালী নিখিল বিশ্বের আদি বীজ । কালের উৎপত্তি যখন হয় নি , তখন ছিলেন মহাকালী । 

“ তম আসীত্তমসা গুঢ়মগ্রে ” ( ঋক ১০/১২৯/৩)

“ তমো বা ইদমেকমগ্র আসীৎ ” ( মৈত্রায়নী শ্রুতি )

এই যে অনাদি অনন্ত শুদ্ধ তমস্ – তন্ত্র শাস্ত্র এঁকেই আখ্যা দিয়েছেন আদ্যাশক্তি কালী রূপে । কালীর এ কালো রুপ বৈভবের মহিমা বাক্য মনের অগোচর । 

মহানির্বাণ তন্ত্র বলেন
“ সৃষ্টৈরাদৌ ত্বমেকাসীত্তোমারুপগোচরম্ ”

হে দেবী , সৃষ্টির আদিতে তমো রুপে তুমিই মাত্র ছিলে , তোমার সে তমোময় রুপ বাক্য ও মনের অগোচর । 

মা কালী মহাশক্তি । যা ছিল , যা আছে এবং যা থাকবে সব মা কালীর মধ্যেই আছে । অনন্ত , আদি , বর্তমান সব কালী মায়ের মধ্যেই আছে । 

ধ্বংসের দেবী 
ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে আছে । যেমন ঘন কালো রাত্রির পর দিন আসে । তেমনি ধ্বংসের পর সৃষ্টি হয় । ঘন কালো মেঘ বিদায় হলেই আকাশে ঝলমলে সূর্য ওঠে । তাই ধ্বংস ছাড়া সৃষ্টির বিকাশ সম্ভব নয় । 

মা কালী হলেন আদ্যাশক্তি । জগতের মূল শক্তি ইনি । ইনি মহা সরস্বতী । ইনিই মহা লক্ষ্মী । ইনি রুদ্রানী শিবানী । ইনি ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী , নারায়নের শক্তি নারায়নী , শিবের শক্তি শিবা । ইনি নারসিংহী , ইনি বারাহী , ইনি কৌমারী , গন্ধেশ্বরী । ইনি শ্রী রামচন্দ্রের শক্তি সীতা দেবী ( বামস্য জানকী ত্বং হি রাবনধ্বংসকারিনী ) , ইনি শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি , ইনি শ্রী রামকৃষ্ণের সহধর্মিণী মা সারদা । ইনি মহিষমর্দিনী চণ্ডী , ইনি চামুন্ডা , কৌষিকী , দুর্গা ভগবতী । এই ব্রহ্মাণ্ড তাঁর ইচ্ছাতেই চলছে । মায়ের ইচ্ছা ভিন্ন গাছের একটা পাতাও নড়ে না । 

সংহার রুপিনী
সংহার শব্দের অর্থ ঠিক ধবংস নয় । সংহরন । নিজের ভিতরে প্রত্যাকর্ষণ । যেমন সমুদ্রের ঊর্মিমালা সমুদ্রের বক্ষ থেকেই উদ্ভুত হয় আবার সমুদ্রেই লয় হয় । যেম্ন উর্ণণাভ নিজের গর্ভ থেকে জাল রচনা করে আবার নিজের পেটেই গুটিয়ে নেয় । মৃত্যুর অর্থ পৃথিবী থেকে , নিকট জনের থেকে চির বিদায় নেওয়া – কিন্তু সেই জগত জননীর কোলে আশ্রয় পাওয়া । 
এই ব্রহ্মাণ্ড সেই মহামায়ার ইচ্ছাতেই রচিত , সংহার কালে তিনি আবার সব গুটিয়ে নেন । 

শিবের ওপর কালী 
মহাদেব এখানে শব রূপ । এর মৃত্যুরুপ শিবের বুকে স্বয়ং জগত মাতা । এর মানে হল মৃত্যু কে জয় । 

দিগম্বরী 

দেবী কালী দিগম্বরী । এর অর্থ তিনি কোন কিছুর বন্ধনে আবদ্ধ নন । তিনি দেশ কালের ওপরে । তিনি সকল জীবের মাতা । 
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন কিছু পণ্ডিত বসনকে কামনা বাসনার প্রতীক বলেছেন । ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গোপীনি দের বস্ত্র হরণ করেছিলেন । যারা মূর্খ , নাস্তিক তারা এর মধ্যে অশ্লীলতার প্রসঙ্গ খোঁজেন । এর মানে কিন্তু এই না আমাদের বসনহীন হয়ে থাকতে হবে । খালি কামনা বাসনা আদি ষড়রিপু বর্জন করতে হবে । তবেই দেবকৃপা পাওয়া যাবে । তাই সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে অহং ও অবিদ্যা কে ত্যাগ করেই মায়ের কাছে যেতে হবে । 

মুক্তকেশী 

মা মুক্ত স্বভাবা । তাই তিনি মুক্তকেশী । তাঁর জ্ঞান খড়গের দ্বারা অষ্টপাশ ছিন্ন হলেই নিস্কাম সাধক দেবীর কৃপা পান । তবেই মুক্তি ঘটে 
রামপ্রসাদ তাই গাইলেন
 
“ মুক্ত কর মা মুক্তকেশী
ভবে যন্ত্রনা পাই দিবানিশি । ”

দেবী কালীর সেই কেশ মৃত্যুর প্রতীক । চন্ডীতে আছে মহিষাসুরের হাতে পরাজিত দেবতারা যখন ত্রিদেবের কাছে গেলেন তখন ত্রিদেব ও সমস্ত দেবতাদের তেজ রাশি একত্রিত হয়ে ভগবতী মহামায়ার আবির্ভাব ঘটে । যমের তেজে দেবীর কেশরাশি গঠিত হয় । 

মুন্ডমালা 

মায়ের কন্ঠে মুণ্ডমালা । কন্ঠমালা পঞ্চাশৎ । যা সংস্কৃত পঞ্চাশৎ বর্ণমালার প্রতীক । শব্দই হল ব্রহ্ম । কামধেনু তন্ত্রে দেবী স্বয়ং বলেছেন 
“ মম কণ্ঠে স্থিতং বীজং পঞ্চাশদ্ বর্ণমদ্ভুতম্ । ”

রামপ্রসাদ তাই গেয়েছেন 

যত শোন কর্ণপুটে সকল মায়ের মন্ত্র বটে ।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে ।


মুন্ডমালা হল জ্ঞান শক্তির প্রতীক । দেবী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন । তিনি চেতনা দান করেন । অন্ধকারে আবদ্ধ জীবকে আলোর পথ দেখান । 

হস্তের মেখলা 

দেবী কালী কটি দেশে নর হস্তের মেখলা । কিন্তু কেন ? হস্ত কর্মশক্তির প্রতীক । 

ত্রিনয়নী 

দেবী কালীর ত্রিনয়ন । দেবীর একটি নয়ন চন্দ্র স্বরূপ , আর একটি সূর্য স্বরূপ । তৃতীয়টি অগ্নি স্বরূপ । দেবী ভূত , ভবিষ্যৎ , বর্তমান সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন । তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই ত্রিকাল নিয়ন্ত্রিত হয় । প্রকাশ্য দিবালোকে , সন্ধ্যায় বা রাত্রে আমরা যে কাজ করি নে কেন তিনি দেখছেন । 
আমরা যদি গোপনে পাপ কাজ করে প্রভাব খাটিয়ে এই পৃথিবীর বিচারসভার হাত থেকে নিস্কৃতি পাইও , তবুও দেবী সব দেখেন – তাঁর বিচার থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যাবে না । 

চারিহস্ত 

দেবীর চার হাত । তাঁর ওপরের দুহাতে অভয় ও খড়গ । নীচে বর মুদ্রা ও ছিন্ন নরমুণ্ড । অভয় ও বরামুদ্রা সৃষ্টির প্রতীক । খড়গ ও ছিন্ন নরমুণ্ড ধ্বংসের প্রতীক । দুটি বিপরীত কাজ হলেও আমরা মা কালীর মধ্যে দুটিকেই দেখতে পাই । এর অর্থ দেবী কালীর ইচ্ছাতেই সৃষ্টি হয় , তার ইচ্ছাতেই ধ্বংস হয় । দেবী তার খড়গ দ্বারা অবিদ্যা রুপী অসুরকে ধ্বংস করেন ।

কৃষ্ণবর্ণ

কালী মাতা কৃষ্ণবর্ণা । আদিতে যখন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কিছুই ছিল না তখনও তিনি ছিলেন । তিনি অনন্ত । তিনি আদিতেও ছিলেন , তাই তিনি কৃষ্ণবর্ণা ।
কখনো তিনি নীলবর্ণা । যা সুদীর্ঘ সুনীল নীল আকাশের তুলনীয় । এর অর্থ দেবী অনন্ত । অনন্ত তার লীলা প্রকাশ । যা ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বরের অগোচর । 
বিবসনা স্তন্য

দেবী কালী উলঙ্গিনী । তাই কিছু নাস্তিক , মূর্খ ও বুদ্ধিজীবি শ্রেনীর মানুষ অনেক সময় খারাপ কিছুর সঙ্গে উলঙ্গিনী মায়ের তুলনা করে বসেন । মা উলঙ্গিনী বটে – কিন্তু তিনি যে তাঁর বাৎসল্যের স্নেহধারা তাঁর সকল সন্তান দের জন্যই রেখেছেন । তিনিই ত অন্নপূর্ণা রুপে ধান , শস্যে ভরিয়ে দিয়েছেন । তিনি শাকম্ভরী , তিনিই শতাক্ষী । মা হল পরম করুণাময়ী । সন্তানের দুঃখে তিনি কাঁদেন , সন্তানের উল্লাসেই তিনি আনন্দিত হন । 
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন । অনেক পণ্ডিতরা বলেন মা শীতলা নাকি সকলকে বসন্ত রোগের জীবানু দেন । এমন কোন মা আছে যে তার সন্তান দের তিনি রোগ দেবেন ? তাঁর সন্তান রা রোগে কষ্ট পাবে আর তিনি দেখবেন । এমন ধারনা ‘মা’ শব্দের অপমান । 

রক্তমাখা জিহ্বা 

দেবীর রক্তমাখা জিহ্বা রজঃ গুনের প্রতীক । তিনি তার শ্বেত দন্ত পাটি দ্বারা জিহ্বা কেটেছেন । শ্বেত বর্ণ হল স্বত্বঃ গুনের প্রতীক । এর মানে মা আমাদের স্বত্বঃ গুন দ্বারা রজঃ গুনকে সংহত করার শিক্ষে দিচ্ছেন । 

মহা শ্মশ্মান বাসিনী 

দেবী মহাশ্মশ্মান এ বিচরণ করেন । কর্মফল ভোগান্তে জীবের শেষ আশ্রয় স্থল হল শ্মশ্মান । যেখানে তারা জননীর কোলে সুখে নিদ্রা যায় । মায়ের আঁচল এর তুলনা কোটী কোটি স্বর্গের সাথেও হয় না । যেখানে বাৎসল্যের ছোঁয়া লেগেই থাকে । “ মায়ের কোলে ঘুমায় ছেলে , এ শান্তি মা কোথায় বল ?”

বিপরীত রতাতুরা

মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম ।।

আদ্যাশক্তি শ্রী শ্রী কালী বিশ্ব প্রসবিনী । পরম পুরুষ মহাকাল শিবের সাথে মিথুন ক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন । এই রতি ক্রিয়া পরমার্থিক । 
                                                       
কালী মূর্তির প্রকারভেদ 

মায়ের অনন্ত কোটি রুপ । তন্ত্রে ৯ রকম কালী মূর্তির কথা আছে । সংক্ষিপ্ত আকারে তা দেওয়া হল । 

দক্ষিণা কালী মাতা 

“ করালবদনাং ঘোরাং ” ধ্যান মন্ত্র টি দক্ষিণা কালীর ধ্যান । তিনি করালবদনা , ঘোরা , মুক্তকেশী , চতুর্ভুজা , দিব্যা এবং মুন্ডমালা বিভূষিতা । তিনি মহা মেঘ প্রভা শ্যামা ও দিগম্বরী । তাঁর গলদেশের মুন্ডমালা থেকে রুধিরধারা বিগলিত হয়ে সর্বাঙ্গ অনুলিপ্ত করছে । তার কর্ণে শবদ্বয় ভূষণ রুপে বিদ্যমান , এবং তাতে তিনি হয়েছেন আরো ভয়ানক । তিনি ঘোর দ্রংষ্ট্রা , করান্যাসা , পীনোন্নতপয়োধরা , শব সমূহের কর দ্বারা দেবীর কাঞ্চী রচিত এবং তিনি হাস্যমুখী । দেবী ঘোররাবা , মহারৌদ্রী ও শ্মশ্মান বাসিনী । তাঁর ত্রিনয়ন নবোদিত সূর্য মণ্ডল স্বরূপ । দেবী সুবিন্যস্ত ও সুপরিপাটী দন্ত বিশিষ্টা , তাঁর আলুলায়িত কেশরাশি দক্ষিণ ভাগে লম্বমান । তিনি শবরুপী মহাদেবের হৃদয়োপরি অবস্থিতা । দেবীর চতুর্দিকে চিৎকার পরায়ণ শিবা গণ অবস্থান করেন এবং দেবী মহাকালের সাথে বিপরীত ক্রিয়াতে রতা । দেবীর বদন সুখপ্রসন্ন , তাঁর শ্রী মুখপদ্ম মৃদুমন্দ হাস্যে সমুজ্জ্বল । 
আমরা সকলে দক্ষিণা কালীর ই পূজো করে থাকি । 

শ্মশ্মান কালী মাতা 

ইনি অঞ্জনাদ্রিনিভা , রক্তনেত্রা , মুক্তকেশী , শুস্কমাংসা , অতি ভৈরবা , পিঙ্গল নয়না । এঁনার বাম হস্তে মাংস ও মদ থাকে দক্ষিণ হস্তে সদ্যশ্ছিন্ন নরমুণ্ড থাকে । ইনি স্মিতবক্ত্রা , সর্বদা আমমাংস চর্বণ তৎপরা , নগ্না , সদা মদ্যপানে প্রমত্তা । ইনি নানা অলঙ্কার পড়েন । 

এঁনার পূজা গৃহস্থ বাড়িতে হয় না । শ্মশ্মানেই এই মায়ের পূজো হয় । 

গুহ্যকালী মাতা 

ইনি মহামেঘপ্রভা , কৃষ্ণ বস্ত্র পরিধান করেন , লোলজিহ্বা , ঘোর দ্রংষ্ট্রা , কোটাক্ষী , হসন্মুখী , এঁনার কন্ঠে নাগ হার । , ভালে অর্ধচন্দ্র , শিরের জটাজাল নভো স্পর্শী । ইনি শব আস্বাদনে আসক্তা । গুহ্যকালী নাগ যজ্ঞপবীত ধারন করেন , নাগশয্যেপরি বিরাজিতা । এঁনার কন্ঠদেশে পঞ্চাশৎ মুন্ড সংযুক্ত বনমালা , ইনি মহোদরী । সহস্র ফনা যুক্ত অনন্ত নাগ এঁর শিরোপরি এঁনার চতুর্দিকে নাগ গণ ফণা তুলে বেষ্টন করে থাকেন । সর্পরাজ তক্ষক দেবীর বাম হস্তের কঙ্কণ এবং অনন্ত নাগ দক্ষিণ হস্তের কঙ্কণ । ইনি নাগ নির্মিত কাঞ্চী ও রত্ন নূপুর ধারন করেন । এঁর বাম দিকে শিব সব্রুপ কল্পিত বৎস্য থাকে । ইনি দ্বিভুজা , এনার শ্রুতি দ্বয় নরদেহসমাবদ্ধ কুন্ডল দ্বারা শোভিত থাকে । ইনি প্রসন্ন বদনা , সৌম্যা , নারদাদি মুনি গণ সেবিতা । কিন্তু পুনশ্চ অট্টহাস্য কারিনী , মহাভীমা , সাধকের অভিষ্ট দায়িনী । 

গুহ্যকালীর পূজো গৃহস্থ বাড়িতে হয় না । তিনি কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা । তবে কিছু পণ্ডিত এর মতে গ্রহ দোষ কাটানোর জন্য গৃহস্থ বাড়ীতে এই মায়ের পূজো করা যেতে পারে । 

সিদ্ধকালী মাতা 

সিদ্ধকালী তার দক্ষিণের হস্তের খড়গ দ্বারা চন্দ্র মণ্ডল উদ্ভিন্ন করছেন । সেই চন্দ্র মণ্ডলের গলিত রস দেবীর সর্বাঙ্গ প্লাবিত করছে । তিনি বাম হস্তের কপাল পাত্রে ঐ অমৃত ধারন করে পান করছেন । দেবী ত্রিনয়নী , মুক্তকেশী , দিগম্বরা । তাঁর কটিদেশ কাঞ্চী দ্বারা বদ্ধ । শিরে মনি মুক্ত খচিত মুকুট । তিনি দীপ্তজীহবা , এঁনার তনু কান্তি নীলোৎপল সদৃশ । কর্ণে তার রবি শশী তুল্য সমুজ্জ্বল কুন্ডল দ্বয় , দেবী আলীঢ়পাদা । 
সিদ্ধকালী মাতা কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা । গৃহস্থ ব্যাক্তিরা এঁনার পূজো করেন না । 

আদ্যাকালী মাতা 

ইনি মেঘাঙ্গী , শশী শেখরা , ত্রিনয়না , রক্তাম্বরা , বরভয়করা , রক্তারবিন্দস্থিতা , মাধ্বীক পুস্পজাত মধুর মদ্য পান পূর্বক তাঁর সম্মুখে নৃত্যপর মহাকালকে দর্শন করে দেবী বিকাসিতাননা । 
আদ্যাকালীর পূজো গৃহস্থ ও সাধক সবাই করতে পারেন । 

মহাকালী মাতা 

তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে মহাকালী পঞ্চদশ নয়না , মহারৌদ্রী । এঁনার হাতে শক্তি , শূল , ধনু , বাণ , খড়গ , খেটক , বর ও অভয় থাকে । শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থানুসারে পুরাকালে ভগবান বিষ্ণুর কর্ণ থেকে মধু আর কৈটভ নামক দুই অসুর জন্মান । তারা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে আক্রমণ করলে , ব্রহ্মদেব প্রান রক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন । কিন্তু যোগমায়ার প্রভাবে ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন । ব্রহ্মদেব তখন ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগানোর জন্য আদিশক্তির স্তব করলেন , ব্রহ্মার স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগিয়ে প্রকট হলেন । ও মহাকালী রুপে প্রকট হলেন । 

দেবী মহাকালী দশবক্ত্রা , দশভুজা , দশপাদা , ত্রিংশ লোচনা , ।  দ্রংষ্ট্রা উজ্জ্বল । ইনি ভয়ঙ্করী । ইনি রুপ , সৌভাগ্য , কান্তি , মহতী , শ্রীর অধিষ্ঠাত্রী । ইনি তার ১০ হাতে খড়গ , বাণ , গদা , শূল , শঙ্খ , চক্র , ভূশণ্ডি , পরিঘ , ধনু , রুধিরাক্ত নরমুণ্ড ধারিনী ।  

কেবল সাধক রাই এঁনার পূজো করতে পারেন । কথিত আছে ইনি প্রথমে সাধককে নানা ভাবে ভয় দেখান । সাধক ভয় তুচ্ছ করে সাধনার পরীক্ষায় সফল হলে ইনি নানা রকম সিদ্ধি দান করেন । 

চামুন্ডাকালী মাতা 

শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থানুসারে চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব দেবী কৌষিকীর সাথে যুদ্ধ করতে আসলে দেবী তার ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করেন । সেখানে থেকেই দেবী চামুন্ডার আবির্ভাব হয় । চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব কে বধ করার জন্য তিনি চামুন্ডা নামে খ্যাত হন । তিনি বিচিত্র নর কঙ্কাল ধারিনী , নরমুণ্ড মালিনী , ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা , অস্থি চর্মসার দেহ স্বরূপা । অতি ভীষনা , বিশাল বদনা , লোলজিহ্বা , ভয়ঙ্করী , কোটর গতা , আরক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং সিংহ নাদে দিক মণ্ডল পূর্ণ কারিনী । 
চামুন্ডাকালী মাতা শব বাহনা । ইনি চতুর্ভুজা । 
এঁনার পূজো কেবল সাধক দের জন্যই । গৃহস্থ বাড়ীতে বা গৃহস্থ লোকেরা এনার পূজো করেন না । 

ভদ্রকালী মাতা 

তন্ত্র মতে ভদ্রকালী ক্ষুধায় ক্ষীণা । কোটোরাক্ষী , মসিমলিনমুখী , মুক্তকেশী । ভদ্রকালীর কর দ্বয়ে জ্বলন্ত অনল শিখার ন্যায় দীপ্ত পাশ যুগ্ম থাকে । দেবী পুরাণ বলেন – দেবী অন্তিমে মৃত্যুকালে ভদ্র বা মঙ্গল বিধান করেন , তাই তিনি ভদ্রকালী । কালিকা পুরাণ মতে দেবীর গাত্রবর্ণ অতসী পুস্পের ন্যায় , এবং কর্ণে উজ্জ্বল কুন্ডল থাকে । তাঁর মস্তক জটাজুট , অর্ধচন্দ্র , মুকুটে ভূষিত , নাগ হার ও স্বর্ণ হার তাঁর ভূষন । তাঁর দক্ষিণ বাহুতে শূল , চক্র , খড়গ , শঙ্খ , বাণ , শক্তি , বজ্র , দন্ড এবং বাম করে খেটক , চর্ম্ম , চাপ , পাশ , অঙ্কুশ , ঘণ্টা , পরশু , মূষল থাকে । ইনি সিংহ বাহনা , তাঁর আরক্ত ত্রিনয়ন অতিশয় দীপ্ত । ইনি বামপদ দ্বারা মহিষাসুরকে আক্রমণ পূর্বক শূল দ্বারা তাকে বিদীর্ণ করে অবস্থিতা । বস্তুত ইনি দুর্গামূর্তি । 

এঁনার পূজো গৃহস্থ ও সাধক উভয়েই করতে পারেন ।

রক্ষাকালী মাতা 

ইনি চতুর্ভুজা , কৃষ্ণবর্ণা , মুন্ডমালা বিভূষিতা । দক্ষিণ কর দ্বয়ে খড়গ , নীলপদ্ম থাকে । বাম কর দ্বয়ে অসি ও খর্পর থাকে । এঁনার গগনস্পর্শী জটিল শীর্ষে এবং কন্ঠে মুন্ডমালা । ইনি রক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং বক্ষে নাগ হার যুক্তা । এঁনার পরিধানে কৃষ্ণ বস্ত্র , কটিতে ব্যাঘ্রচর্ম । ইনি বাম পদ শব হৃদয় এ এবং দক্ষিণ পদ সিংহ পৃষ্ঠে স্থাপন পূর্বক মদ্যপানে নিরতা । ইনি অট্টহাস্যা , মহাঘোররাবযূতা এবং সু ভীষণা । 

দারুকাসুর মর্দিনী কালী মাতা 
লিঙ্গ পুরান এ এই কালী মায়ের কথা বলা আছে । ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ পূর্বক মহাদবের কন্ঠে স্থিত গরলে নিজ তনু কৃষ্ণ বর্ণ করেছেন । মহাদেবের ন্যায় ইনি ত্রিশূল ধারিনী , শ্রীকরে সর্প বলয় যুক্তা । লিঙ্গ পুরান মতে ইনি দারুক নামক এক অসুরকে বধ করেছিলেন । এনাকে শ্রী কালী ও বলা হয় । 

অন্তিমে সকলে আমরা সেই আদ্যাশক্তি মা কালীকে বন্দনা করি । তিনি আমাদের সকলের মধ্যে শক্তিরুপে জেগে উঠুন । তাঁর শক্তিতেই যেন আমরা বলবান হই । কোন ক্লীবতা যেনো আমদের স্পর্শ করতে না পারে । অন্তিমে যেনো সেই জগত জননীর কোলে ফিরে যেতে পারি । 

জাগো , জাগো, জাগো জননী ,
তুমি না জাগিলে শ্যামা 
আর তো কেউ জাগে না মা ,
তুমি না নাচিলে মাগো
নাচিবে না ধমনী ।

দীপাবলি ও আলোর উৎসব 

শ্রী শ্রী কালী মা সাক্ষাৎ ব্রহ্মময়ী । তিনি আমাদের অবিদ্যা রুপিনী অন্ধকার কে নাশ করে আমাদের জ্ঞান দেন , চেতনা দেন । তাঁর ত্রিনয়ন চন্দ্র , সূর্য , অগ্নি । তার লোমকূপ সকল কোটি কোটি প্রতীপ্ত তারকা । তার আবির্ভাবে অন্ধকার ময় অবিদ্যা , আসুরিক শক্তি নাশ হয়ে যায় । তাই কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় আমরা শত শত প্রদীপের আলোকমালায় সেই জগত মাতাকে বরন করে নেই । প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আমাদের অন্ধকার অবিদ্যার জাল থেকে মুক্ত করে দেন । 

দেশপ্রেম ও মা কালী

জগতজননী মা ও ভারতমাতা অভিন্না । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ‘আনন্দমঠ’ তিনি ভারতমাতা ও মহিষমর্দিনী দুর্গাকে এক বলে বর্ণনা করেছেন ।
 
“ বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি গড়ি মন্দিরে মন্দিরে ।
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরনধারিনী 
কমলা কমল – দলবিহারিণী ”


“ – “ এই যে মা হইবেন । দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত ,- তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত , পদতলে শত্রু  বিমর্দিত , পদাশ্রিত , বীরকেশরী , শত্রু নিপীড়নে নিযুক্ত । দিগভুজা ” (আনন্দমঠ / একাদশ পরিচ্ছেদ ) 

পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয় বিপ্লবীরা ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যখন প্রস্তুত হতেন – প্রথমেই নিতে হত জগত জননী কালী মায়ের আশীর্বাদ । কথিত আছে বিপ্লবী রা কালীঘাট বা তারাপীঠ গিয়ে দেবীর চরণ ছুয়ে দেশমাতৃকার উদ্ধার এর জন্য কঠোর সংকল্প নিতেন । 

ফাঁসীর আগে যখন ক্ষুদিরাম কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল “ অন্তিম ইচ্ছা কি? ”ক্ষুদিরাম জানিয়েছিলেন , তিনি দেবী চতুর্ভুজার প্রসাদ খেতে চান । ( আঠেরোর দীপ্তশিখা ক্ষুদিরাম/ লেখক- সুশান্তকুমার সাহিত্যরত্ন)

Monday, October 29, 2012

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা

লক্ষ্মী দেবীর ধ্যান মন্ত্রে বলা হয় “ যাম্য করে পাশ , অক্ষমালা , সৌম্য করে পদ্ম ও অঙ্কুশ ধারিনী পদ্মাসনে উপবিষ্টা , শ্রী অর্থাৎ ঐশ্বর্য সম্পৎ ও সৌন্দর্য রুপিনী , ত্রিলোকের জননী , গৌরবর্ণা , সুন্দরী , সর্বা অলঙ্কার বিভূষিতা , ব্যগ্রহস্তে স্বর্ণ পদ্ম ধারিনী এবং দক্ষিণ হস্তে বরদানকারিনী দেবীকে ধ্যান করি । 

লক্ষ্মী স্ত্রোত্র এ বলা হয় 

 
লক্ষ্মীঃ শ্রীঃ কমলা বিদ্যা মাতা বিষ্ণুপ্রিয়া সতী ।
পদ্মালয়া পদ্মহস্তা পদ্মাক্ষী পদ্মসুন্দরী ।।
ভূতানামীশ্বরী নিত্যা মতা সত্যাগতা শুভা ।
বিষ্ণুপত্নী মহাদেবী ক্ষীরোদতনয়া ক্ষমা ।।
অনন্তলোকলাভা চ ভূলীলা চ সুখপ্রদা ।
রুক্মিণী চ তথা সীতা মা বৈ বেদবতী শুভা ।।
এতানি পুন্যনামানি প্রাতরুথায় যঃ পঠেৎ ।
মহাশ্রিয়নবাপ্নোতি ধনধান্যকল্মষম্ ।।


শ্রী , কমলা বিদ্যা , মাতা , বিষ্ণুপ্রিয়া , সতী , পদ্মালয়া পদ্মহস্তা পদ্মাক্ষী পদ্মসুন্দরী , ভূতগণের ঈশ্বরী , নিত্যা , সত্যাগতা , শুভা , বিষ্ণুপত্নী , ক্ষীরোদ – তনয়া , ক্ষমা স্বরূপা , অনন্তলোকলাভা , ভূলীলা , সুখপ্রদা , রুক্মিণী , সীতা , বেদবতী – দেবীর এ সকল নাম । প্রাতেঃ উত্থান কালে যারা দেবীর এই পুন্য নামাবলী পাঠ করেন তারা বিপুল ঐশ্বর্য পেয়ে ধনী হয়ে থাকেন । 

অগ্নি পুরাণ মতে শ্রী বা লক্ষ্মী হলেন যজ্ঞবিদ্যা , তিনিই আত্ম্যবিদ্যা , যাবতীয় গুহ্যবিদ্যা ও মহাবিদ্যা ও তিনি । 

যজ্ঞবিদ্যা মহাবিদ্যা গুহ্যবিদ্যা চ শোভনা ।
আত্ম্যবিদ্যা চ দেবি বিমুক্তিফলদায়িনী ।।

দেবী ভাগবত মতে যে স্বর্গে তিনিই স্বর্গ লক্ষ্মী , রাজগৃহে তিনি রাজলক্ষ্মী , গৃহে তিনি গৃহলক্ষ্মী । তিনি শান্তা , দান্তা , সুশীলা , সর্ব মঙ্গলা , ষড়রিপু বর্জিতা । 

এক কথায় ধন , জ্ঞান , শীল – তিনেরই বিকাশ দেবী লক্ষ্মীর মধ্যে । কমলের মতো তিনি সুন্দরী , কমলাসনে তাঁর নিবাস । কমল বা পদ্ম হল বিকাশ বা অভ্যুদয়ের প্রতীক । 

পুরানে আছে সাগর মন্থন কালে দেবী লক্ষ্মী সমুদ্র থেকে প্রকট হন । সাগর হল লক্ষ্মী দেবীর পিতা । সাগরেই মুক্তা , প্রবাল আদি রত্ন পাওয়া যায় । রত্ন হল ধন , যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন লক্ষ্মী । 
তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া । তিনি শ্রী বিষ্ণুর সহধর্মিণী । তিনি সীতা , তিনি রাধা তথা রুক্মিণী । তিনি মহাপ্রভুর সহধর্মিণী লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী । তিনি ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের সহধর্মিণী মা সারদা । শরত ঋতু তে আমরা যে দুর্গাদেবীর পূজো করি তিনিও মহালক্ষ্মী স্বরূপা । দেবী লক্ষ্মী মহামায়া আদিশক্তির এক অংশ । 

দেবী লক্ষ্মী কে চঞ্চলা বলা হয় । কারণ লক্ষ্মী দেবী নাকি এক জায়গায় থাকেন না । ধন হস্তান্তর হয় । কুপাত্রের হাতে বিপুল ধন আসলে সে ধনের অসৎ প্রয়োগ করে লক্ষ্মী কে হারায় । রাবণ লক্ষ্মী সীতা দেবীকে অসৎ উপায়ে ভোগ করতে চেয়েছিলেন , এই কারনে গোটা লঙ্কা ধ্বংস হয়েছিল । রাবন নিহত হয়েছিলেন । এই থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করি লক্ষ্মীর কৃপা সব সময় এ শুভ কাজেই ব্যবহার করা উচিৎ । এবং কখনো অসৎ উপায় অবলম্বন করে লক্ষ্মী প্রাপ্তির আশা করা উচিত নয় । না হলে রাবনের মতো আমাদেরও বিনাশ নিশ্চিত । 

দেবী লক্ষ্মীর নিবাস কোথায় ? তিনি কি খালি বৈকুন্ঠে শ্রী বিষ্ণুর পাদপদ্মে থাকেন ?


 যেখানে শীল ও সদাচার থাকে দেবী সেখানেই বাস করেন । ব্রহ্ম বৈবরত পুরানে দেবী নিজ পরিচয় দিয়েছেন 
“ যে সকল গৃহে গুরু , ঈশ্বর , পিতামাতা , আত্মীয় , অতিথি , পিতৃলোক রুষ্ট হন , সে সকল গৃহে আমি কদাপি প্রবেশ করি না । আমি সে সকল গৃহে যেতে ঘৃনা বোধ করি , যে সকল ব্যাক্তি স্বভাবতঃ মিথ্যাবাদী , সর্বদা কেবল ‘নাই’ , ‘নাই’ করে , যারা দুর্বলচেতা এবং দুঃশীল । যারা সত্য হীন , মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে , বিশ্বাসঘাতক , কৃতঘ্ন , যে সকল ব্যাক্তি সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত , ভয়গ্রস্ত , শত্রু গ্রস্ত , ঋণ গ্রস্ত , অতি কৃপণ , দীক্ষা হীন , শোকার্ত , মন্দঘ্নী , স্ত্রী বশীভূত , কুলটার পতি , দুর্বাক , কলহ পরায়ণ , যারা ভগবানের পূজো ও তাঁর নাম গুন কীর্তনে বিমুখ , যারা শয়নের পূর্বে পাদপ্রক্ষালন করে না , নগ্ন হয়ে শয়ন করে , বেশী ঘুমায় , প্রভাতে সন্ধ্যায় দিবসে নিদ্রা যায় , যাদের দন্ত অপরিচ্ছন্ন , বসন মলিন , মস্তক রুক্ষ , হাস্য বিকৃত , তাদের গৃহে আমি কদাপি গমন করি না । 

আমি সে সকল গৃহে বসতি করি , যে সকল গৃহ শ্বেত পারাবত অধুষ্যিত , যেখানে গৃহিণী উজ্জ্বল সুশ্রী , যেখানে কলহ নাই , ধান্য সকল সুবর্ণ সদৃশ , তণ্ডুল রজতোপম এবং অন্ন তুষহীন । যে গৃহস্থ পরিজনের মধ্যে ধন ভোগ্য বস্তুর সমান বিভাগ পূর্বক বিতরণ করেন , যিনি মিষ্টভাষী , বৃদ্ধপোসেবী , প্রিয়দর্শন , স্বল্পভাষী , অ দীর্ঘ সূত্রী , ধার্মিক , জিতেন্দ্রিয় , বিদ্যা বিনয়ী , অ গর্বিত , জনানুরাগী , পরপীড়ন বিমুখ , যিনি ধীরে স্নান করেন , চয়িত পুস্প আঘ্রাণ করেন না , সংযত এমন ব্যাক্তি আমার কৃপা পেয়ে থাকেন । ”

শুধু অর্থ নয় , উন্নত চরিত্রও মানুষের অমূল্য সম্পদ । লক্ষ্মী দেবীর কৃপা তাঁরাই লাভ করেন যারা নৈতিক চরিত্রের অধিকারী । লক্ষ্মী র কৃপা সব সময় সৎ কাজেই ব্যাবহার করা উচিত । মানুষ যদি লক্ষ্মী র অপপ্রয়োগ করেন ত অলক্ষ্মীর শাপে সে ধ্বংস হবেই । যে শুদ্ধ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী তাঁর গৃহে লক্ষ্মী অচলা হয়ে অবস্থান করেন । আর যারা ঠিক এর উল্টো তারা কর্মদোষে অলক্ষ্মীর আহ্বান করে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয় । লক্ষ্মী হল ‘শ্রী’ । সকল নারীর মধ্যে যে শীল ও সদাচার আছে তার মাধ্যমেই তিনি প্রকাশিতা । তাই যেখানে নারী দের প্রতি অবমাননা হয় , বা যারা নারী দের ওপর নির্যাতন করেন – সেই সব জায়গায় কখনই দেবী লক্ষ্মীর কৃপা বর্ষণ হয় না । 

কথিত আছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবী রাত্রে খোঁজ নেন – কে জেগে আছেন ? যে জেগে অক্ষক্রীড়া করে , লক্ষ্মী তাঁকে ধন সম্পদ দান করেন ।



নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী ।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ ।।



অক্ষক্রীড়া শব্দের সাধারন অর্থ পাশা খেলা । এক শ্রেনীর লোক এই দিন পাশা খেলার মাধ্যমে টাকা পয়সা বাজি রেখে জুয়া খেলায় মেতে ওঠে । আবার কেউ কেউ এই দিন পরের বাগানের ফলমূল চুরি করে গাছপালা তছনছ করে । এই সব অর্থহীন কাজের মাধ্যমে তারা ভাবে যে লক্ষ্মী দেবী তাদের কৃপা করবেন । 
‘অক্ষ’ শব্দটির অনেক রকম মানে হয় । অক্ষ শব্দটির দ্বিতীয় অর্থ – ক্রয় বিক্রয় চিন্তা । যারা বৈশ্য তাঁরা এইদিন দেবীর আরাধনা করে ব্যবসা বাণিজ্যের চিন্তন করেন । দেবীর কৃপা পেলেই ত ব্যবসায় সফলতা আসবে । ‘অক্ষ’ শব্দটির আরেক ভাবে রুদ্রাক্ষ , জপমালা কেউ বোঝায় । যারা ভক্ত মানুষ – তাঁরা এই রাত্রে দেবীর কৃপা পাবার আশায় তাঁর নাম জপ করেন । ধন সম্পদ বলতে শুধু কি অর্থ , সোনা দানা ? বৈকুণ্ঠ ধাম , শ্রী বিষ্ণুর পাদপদ্ম পরম ধন । লক্ষ্মী পূজোর রাত্রে দেবী আসেন মর্ত্যলোকের দ্বারে দ্বারে । কিন্তু যে ঘুমিয়ে থাকে তার দ্বার থাকে লক্ষ্মী দেবী চলে যান । কিন্তু যিনি জেগে ভক্তি চিত্তে লক্ষ্মী জনার্দনের উপাসনা , নামস্মরণ করেন – দেবী তাঁকেই কৃপা করেন । 

পেঁচক মা লক্ষ্মীর বাহন । ধান হল লক্ষ্মীর প্রতীক । চাল , অন্ন , খাদ্যশস্য হল লক্ষ্মীর প্রতীক । তাই যারা খাদ্য অপচয় করেন , তাঁদের ওপর দেবী লক্ষ্মী কখনোই তুষ্ট হন না । ধানক্ষেতের আশেপাশে মূষিক এর বাস । এবং এরা ধানের ক্ষতি করে থাকে । পেঁচক এর আহার হল এই মূষিক । গোলাঘর কে লক্ষ্মীর প্রতীক বলা হয় । গোলাঘরের আশেপাশে মূষিক কূলের নিবাস । পেচক এই মূষিক দের ভক্ষণ করে খাদ্যশস্য কে রক্ষা করে । তাই এদিক থেকে পেঁচক মা লক্ষ্মীর বাহন হিসাবে যথার্থ মানানসই । 

পেঁচক দিনে অন্ধ । সে রাত্রে জাগে । তাই আমরা যেনো পরধন সমন্ধে তেমন অন্ধ হই । কখনো যেনো অন্যের ধন আত্মস্যাৎ করার ইচ্ছা মনে না জাগে ? 


ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন 

যা নিশা সর্বভূতানাং সা নিশা জাগরতি সংযমী । 
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশাতো মুনেঃ ।।


অর্থাৎ সর্ব ভূতের যা রাত্রি , সংযমীর পক্ষে তা দিন । তাঁদের যা দিন , তাঁর তা রাত্রি । সকল প্রানী পরমার্থ বিষয়ে নিদ্রিত কিন্তু বিষয়ভোগে জাগ্রত । কিন্তু সংযমী সাধু যোগী পরমার্থ বিষয়ে জাগ্রত , বিষয়ভোগে নিদ্রিত । দেখা যায় দিবাকালে অন্য প্রাণীরা যখন জাগ্রত পেচক তখন নিদ্রিত । পেচক নিশাচর । নিশীথের নিস্তব্ধ পরিবেশ সাধুদের সাধনার অনুকূল । তাই পেচক আমেদের পরমার্থ চিন্তার আদর্শ সেখায় , যার মাধ্যমে আমরা দেবীর কৃপা পেতে পারি । 

আসুন আমরা সকলে কোজাগরী পূর্ণিমার শুভ তিথিতে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনায় ব্রতী হই ।


Posted By: Suman Basak

Thursday, October 25, 2012

पापांकुशा एकादशी


 पापांकुशा एकादशी
================================================= 
King Yudhishthar asked to Lord Krishna...: hey Madhusudan, please tell me the glory of the ekadashi of Ashwin Shukla Paksh ..?"
Lord Krishn said ,"Hey king, the ekadashi of Ashwin Shukla Paksh,is known as Paapankusha Ekadashi.

It just washes away all the paapas[sins],it provides one with heaven and moksha[deliverance],it provides one
good health, money and wealth.Even if a person keeps this fast just like that, he will not ever have to experience the tortute of the yama[God of death]."

"Hey king with the fast of ekadashi, and jaagran { night awakening}, people go easily
to the Vaikuntha, by having a divine form with four arms,decorated with ornaments and yellow clothes,on a plane having a flag of Garuda.Hey king of kings, 
such people deliver, rescue 10 previous generations of the maternal side,10 previous generations of the paternal side, and 10 previous generations of wife's side
one should worship Vasudas on that day.The result that Abstinent sages get after doing hard tapasya [meditation] for years that very 
result one gets only by doing pranaam to the flag of Garuda."
"Those men who give alms of gold,sesame,cow,land,grain,water,shoes,umbrella,he never sees yamraj{God of death}
hey king,even the poor people should meditation,holy bath,meditation,yagna, alms on his accord and should make his life blessful.
Those people who do yagna,bath, japa,meditation,and do good karmas,they never experience the toture of yama.The people 
who are long lived,rich,healthy,they have done good karmas in their previous lives.What else can be said about this, those who do good karmas,
go to heaven and those who do bad karmas rot in hell."
Hey king I have told you the story of Paapankusha Ekadashi, any further questions..?"


पापांकुशा एकादशी

युधिष्ठिर ने पूछा : हे मधुसूदन ! अब आप कृपा करके यह बताइये कि आश्विन के शुक्लपक्ष में किस नाम की एकादशी होती है और उसका माहात्म्य क्या है ?

भगवान श्रीकृष्ण बोले : राजन् ! आश्विन के शुक्लपक्ष में जो एकादशी होती है, वह ‘पापांकुशा’ के नाम से विख्यात है । वह सब पापों को हरनेवाली, स्वर्ग और मोक्ष प्रदान करनेवाली, शरीर को निरोग बनानेवाली तथा सुन्दर स्त्री, धन तथा मित्र देनेवाली है । यदि अन्य कार्य के प्रसंग से भी मनुष्य इस एकमात्र एकादशी को उपास कर ले तो उसे कभी यम यातना नहीं प्राप्त होती ।

राजन् ! एकादशी के दिन उपवास और रात्रि में जागरण करनेवाले मनुष्य अनायास ही दिव्यरुपधारी, चतुर्भुज, गरुड़ की ध्वजा से युक्त, हार से सुशोभित और पीताम्बरधारी होकर भगवान विष्णु के धाम को जाते हैं । राजेन्द्र ! ऐसे पुरुष मातृपक्ष की दस, पितृपक्ष की दस तथा पत्नी के पक्ष की भी दस पीढ़ियों का उद्धार कर देते हैं । उस दिन सम्पूर्ण मनोरथ की प्राप्ति के लिए मुझ वासुदेव का पूजन करना चाहिए । जितेन्द्रिय मुनि चिरकाल तक कठोर तपस्या करके जिस फल को प्राप्त करता है, वह फल उस दिन भगवान गरुड़ध्वज को प्रणाम करने से ही मिल जाता है ।

जो पुरुष सुवर्ण, तिल, भूमि, गौ, अन्न, जल, जूते और छाते का दान करता है, वह कभी यमराज को नहीं देखता । नृपश्रेष्ठ ! दरिद्र पुरुष को भी चाहिए कि वह स्नान, जप ध्यान आदि करने के बाद यथाशक्ति होम, यज्ञ तथा दान वगैरह करके अपने प्रत्येक दिन को सफल बनाये ।

जो होम, स्नान, जप, ध्यान और यज्ञ आदि पुण्यकर्म करनेवाले हैं, उन्हें भयंकर यम यातना नहीं देखनी पड़ती । लोक में जो मानव दीर्घायु, धनाढय, कुलीन और निरोग देखे जाते हैं, वे पहले के पुण्यात्मा हैं । पुण्यकर्त्ता पुरुष ऐसे ही देखे जाते हैं । इस विषय में अधिक कहने से क्या लाभ, मनुष्य पाप से दुर्गति में पड़ते हैं और धर्म से स्वर्ग में जाते हैं ।

राजन् ! तुमने मुझसे जो कुछ पूछा था, उसके अनुसार ‘पापांकुशा एकादशी’ का माहात्म्य मैंने वर्णन किया । अब और क्या सुनना चाहते हो?
ॐ ॐ

Wednesday, October 24, 2012

বিজয়া দশমী


শুভ বিজয়া দশমী






     সকলকে জানাই শুভ বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা !
   
   Facebook Group :   www.facebook.com/groups/OmSabha
  
 Facebook  Page  :   www.facebook.com/OmSabha

 WebSite:  www.omsabha.co.cc
          
   Email Id : sabhaom@gmail.com




Monday, October 15, 2012

গদ্যে শ্রী শ্রী চন্ডী


( দেবীর আবির্ভাব )


বহু আগে যখন দ্বিতীয় মনু ছিলেন তখন চৈত্রের বংশ জাত রাজা সুরথ পৃথিবীর এক মাত্র অধীশ্বর ছিলেন । তিনি তার প্রজাদের পুত্রসম স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে রাজ্য শাসন করতেন । একদা যবন রাজারা তার রাজ্য আক্রমণ করেন । যুদ্ধে রাজা সুরথ এর পরাজয় হয় । তার রাজ্য , সিংহাসন , ধন, সম্পদ সব শত্রুর হাতে চলে যায় । তিনি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন । মনের দুঃখে তিনি বনে চলে যান । সেখানে তিনি বিষন্ন মনে ঘুরতে থাকেন । 

বনে গিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে রাজা খানিকটা এগিয়ে গেলেন । সেখানে তিনি এক মুনির আশ্রম দেখতে পেলেন । আশ্রমে ঢুকে জানতে পারলেন এটি মেধস্ মুনির আশ্রম । রাজা সেখানে চিন্তা করতে লাগলেন “ অতীতে আমার পূর্বপুরুষ গন যে রাজ্যকে সুন্দর ভাবে পালন করিয়াছেন , তাহা এখন দুষ্ট অমাত্য দের দখলে । তারা এখন সকল প্রজাদের রক্ষা করিতেছেন কিনা ? জানি না সেই মহাবলবান মদস্রাবী প্রধান হাতিটি শত্রুদের অধিকৃত হয়ে ঠিকঠাক খাবার পাচ্ছে কিনা ? যে সকল রাজ কর্মচারী আগে পারিতোষিক , বেতন , খাদ্যদ্রব্য পেয়ে আমার অনুগত থাকত , আজ তারা অন্যের দাসত্ব করছে । আমি এত কষ্ট করে , দুঃখ করে যে বিশাল ধনরাশি জমা করেছিলাম তা ঐ অমিতব্যয়ী গন অপচয় করে শেষ করবে” । 

অপর দিকে সমাধি নামক এক বৈশ্য সেই বনে বিষন্ন মনে চলে আসেন । সমাধি বৈশ্য এক বিত্তশালী ঘরের ছিলেন । তিনি ছিলেন ধনী । কিন্তু তার স্ত্রী ও পুত্রেরা সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে তাকে পরিত্যাগ করেন । ঘটনাচক্রে সমাধি বৈশ্য বনে ভ্রমণ করতে করতে মেধস মুনির আশ্রমে পৌছালেন ।

সমাধি বৈশ্য কে সেখানে দেখে রাজা সুরথ তার পরিচয় জানতে চাইলে সমাধি বৈশ্য তার পরিচয় ও দুঃখের কারণ জানালেন । সমাধি বৈশ্য জানালেন “ আমার অসাধু স্ত্রী ও পুত্রেরা ধনের লোভে আমাকে পরিত্যাগ করেছে । আমি এখন ধনহীন দরিদ্র । আমার আত্মীয় কুটুম্ব , বন্ধু বান্ধব রা আমাকে পরিত্যাগ করায় আমি মনে অনেক দুঃখ নিয়ে বনে চলে এসেছি । কিন্তু এখানে এসেও আমি আমার স্ত্রী , পুত্র ও বন্ধু দের ভুলতে পারছি না । তারা কেমন আছে , তারা ভালো না খারাপ পথে চলছে তাও আমি জানি না।”

রাজা সুরথ বললেন “ যে আত্মীয় ও স্ত্রী পুত্রেরা ধন লোভে আপনাকে পরিত্যাগ করল তাদের জন্য আপনার মন এত স্নেহাসক্ত হচ্ছে কেন ?”
সমাধি বৈশ্য বললেন “ আপনি আমার সম্পর্কে ঠিক বলেছেন । কিন্তু আমি আমার মনকে নিষ্ঠুর করতে পারছি না । বরং তাদের প্রতি আমার মন আরো আসক্ত হচ্ছে । তাদের জন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে । আমি আমার মনকে নিষ্ঠুর করতে পারছি না ।”

রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য এরপর মেধস্ মুনিকে প্রনাম জানিয়ে বললেন – “ হে ভগবন , আপনার কাছে একটি প্রশ্ন করি । আপনি কৃপা করে তার উত্তর দিন । আমার মন আমার নিজের বশীভূত নয় । সেজন্য আমার হারানো রাজ্যাদিতে এখনও আমার মমতা আছে । আমি এও জানি যে এই হারানো মমতা দুঃখের কারন । কিন্তু এমন জানা সত্ত্বেও আমার হারানো রাজ্য ও রাজ্যের অঙ্গ গুলির জন্য আমার যে আসক্তি বা মমতা থেকে গেছে এর কারণ কি ? এই সমাধি বৈশ্য কেও তার স্ত্রী ও পুত্রেরা তাঁর ধন থেকে বঞ্চিত করেছে । তাঁর অমাত্য কর্মচারীরা তাকে বর্জন করেছে , আত্মীয় স্বজন রাও তাকে ছেড়ে চলে গেছে । কিন্তু তবুও ইনি সেই তাদের প্রতি একান্তভাবেই আসক্ত । এই ভাবেই ইনি ও আমি উভয়েই খুব দুঃখিত হয়েছি । কারণ স্ত্রী- পুত্র – রাজ্যাদি বিষয়ে দোষ দেখেও তাদের প্রতি আমাদের মন মমতায় আকৃষ্ট হয়ে আছে । হে মহামতি , আমারও এরকম জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আমাদের এই মোহ কি জন্য ? এইরকম মূঢ়তা বিবেকহীন লোকেদেরই হয়ে থাকে ।”

মেধস্ ঋষি বললেন – “ হে মহাভাগ , সকল প্রাণীরই রূপ , রস , প্রভৃতি সম্পর্কিত ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান আছে এবং সে সব বিষয় সমূহ কিভাবে তাদের জ্ঞান গোচর হয় তা আপনাদের বলছই

পেঁচা বা তার মত প্রানী দিনের বেলায় দেখতে পায় না । তারা অন্ধ হয়ে থাকে । আবার কাক বা তার মতো প্রানী রাতের বেলায় দেখতে পায় না । আবার অনেক প্রানী দিন রাত সর্বদা অন্ধ থাকে । আর বিড়ালের মতো প্রানী দিন রাত সব সময় দেখতে পায় । একথা সত্য যে মানুষের বিষয় জ্ঞান আছে । কিন্তু তাদেরই শুধু বিষয় জ্ঞান আছে – একথা ঠিক না । কারণ পশু পাখী হরিণ , মাছ সকল প্রাণীরই বিষয় জ্ঞান আছে , মানুষেরও তেমনি বিষয় জ্ঞান আছে । আবার মানুষের যে রকম বিষয়ে জ্ঞান আছে পশু পাখীদেরও সেরকমই আছে । আহার , নিদ্রা প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞান পশু- পাখী এবং মানুষ উভয়েই সমান ।

দেখুন  পাখীরা যে খাবার সংগ্রহ করে তাই তাদের শাবকের মুখে তুলে দেয় । এর ফলে তারা খেলেও তাদের ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না । একথা আমরা যেমন জানি বুঝি তেমনি পাখীরাও বুঝে । অথচ সব জেনে বুঝেও তারা শস্যকণা তাদের শাবক দের মুখে তুলে দিতে কত আগ্রহ । হে নরশ্রেষ্ঠ , এই মানুষ দের ক্ষেত্রে আবার দেখছেন না , তারা ভাবে তাদের সন্তান ভবিষ্যতে তাদের প্রত্যুপকার করবে ; সেই লোভে তারা তাদের সন্তান দের প্রতি কতই না অনুরক্ত হয় ? তবুও সংসারের স্থিতি কারিনী মহামায়ার প্রভাবে জীব গণ মোহ রুপ গর্তে এবং মমতা রুপ আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে । এই মহামায়াই জগতের অধিপতি বিষ্ণুর যোগনিদ্রা স্বরুপিনী । তার দ্বারাই এই সারা জগত মোহিত হয়ে আছে । সুতরাং এ বিষয়ে আশ্চর্য হওয়া উচিত নয় । এমনকি সেই দেবী ভগবতী মহামায়ার প্রবল প্রতাপ থেকে জ্ঞানবান বা বিবেক সম্পন্ন মানুষেরও রেহাই নেই । সেই মহামায়া তাদের চিত্তকে জোর করে আকর্ষণ করে মোহের দ্বারা আবৃত করে রাখেন । অতএব যারা সাধারন মানুষ তারা যে তার মোহপাশে আবদ্ধ থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কি ?

সেই মহামায়া এই সমস্ত চরাচর জগত কে সৃষ্টি করেছেন । তিনি প্রসন্না হলে তাঁরই কৃপায় মানুষ মুক্তিলাভ করে থাকে । সেই মহামায়াই সংসার থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় । তিনিই পরমা ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী ও সনাতনী । তিনি সংসার বন্ধনের কারন স্বরুপিনী অবিদ্যা এবং তিনি ব্রহ্মা , বিষ্ণু প্রভৃতি সকল ঈশ্বরের ঈশ্বরী ,অধিশ্বরী । ”

এই কথা শুনে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য জিজ্ঞেস করলেন – “ হে ভগবন , আপনি যাঁকে মহামায়া বলছেন – সেই দেবী কে? তিনি কি রুপে উৎপন্না হন ? 
সেই মহামায়ার স্বভাব কি রকম ? তাঁর স্বরূপ কি রকম ? এবং যে জন্য তেনার আবির্ভাব হয় তা আমি আপনার থেকে শুনতে ইচ্ছা করি ।”

মুনি বলিলেন – “ সেই মহামায়া নিত্যা । এর অর্থ তার জন্ম নেই । মৃত্যু নেই । আবার এই জগত প্রপঞ্চ তাঁরই বিরাট মূর্তি । তিনি সর্বত্রই বিরাজমানা । তিনি নিত্যা । তাও তাকে বহুবার আবির্ভূত হতে হয়েছে ও হতে হয় । আমি আপনাদের কাছে সেই কথা বলছি । আপনারা তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন ।”

( মধু কৈটভ বধ )

পূর্বে প্রলয়কালীন সাগর জলে অখিল বিশ্ব পরিব্যাপ্ত এবং ত্রিভুবন বিলীন হলে যখন ভগবান বিষ্ণু অনন্ত নাগ শয্যায় শয়ন করছিলেন তখন তাঁর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামক দুই অসুর প্রকট হলেন । তারা জলে খেলা করে বেশ কিছুদিন কাটালো । একদা তাদের মনে প্রশ্ন জাগল যে, এই জলরাশি কোন বস্তুর ওপর অবস্থান করছে ? কে এর সৃষ্টি কর্তা ? কি ভাবে এটি সৃষ্টি হয়েছে ? আমাদের বাবা মা কে?
অসুর দ্বয় এই প্রশ্নের কথা ভাবতে লাগলো । এমন সময় কৈটভ বলল – “ ভাই আমার মনে হয় , আমাদের যে এই জলের মধ্যে থাকা অচলা শক্তি আছে , তাই সব কিছুর কারন হবে । এই জলরাশি সেই শক্তিতে পরিব্যাপ্ত হয়ে তাতেই অবস্থিত আছে । সেই পরমা দেবী আমাদের কারণ হবেন । ”

চিন্তায় ব্যাকুল তারা দুইজন তখন আকাশে একটি বাগবীজ শুনতে পেলো । তারা সেই বীজ উচ্চারন করতে থাকল । এভাবে তারা শুদ্ধচিত্তে হাজার বছর তপস্যা করল ।

একদা তারা নারী কণ্ঠ শুনতে পেলো । দেবী বলছেন “ হে দানব দ্বয় । আমি তোমাদের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়েছি । তোমরা বর প্রার্থনা কর । ”

দুই দানব ইচ্ছামৃত্যুর বর চাইলো । দেবী তাদের তাই বর দিলেন । তখন দুই দানব জলে খেলা করে বেড়াতে লাগলো । হটাত তারা একদিন ভগবান শ্রী হরির নাভি পদ্মে ধ্যানমগ্ন ব্রহ্মা কে দেখতে পেলেন । তারা তখন ব্রহ্মা কে আক্রমণ করলেন । ব্রহ্মা তখন আত্মরক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন । তিনি ভগবান বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন । কিন্তু ভগবান যোগ নিদ্রায় মগ্ন । তিনি জাগলেন না । ব্রহ্মা বুঝতে পারলেন ভগবান বিষ্ণু যোগমায়ার প্রভাবে যোপ নিদ্রায় আছন্ন । তাই যোগমায়া ভগবান বিষ্ণু কে প্রভাব মুক্ত না করলে তিনি জাগবেন না । তাই ব্রহ্মা সেই আদ্যাশক্তির স্তব করতে লাগলেন ।

ব্রহ্মার স্তব

“ হে নিত্যে , হে অক্ষরে , তুমি দেবতাদের উদ্দ্যেশে হবিঃ দানের ‘স্বাহা’ মন্ত্র । তুমি পিতৃলোকের উদ্দ্যেশে দ্রব্যদানের ‘ স্বধা ’ মন্ত্ররূপা । তুমি দেবতাদের আহ্বানের বষট্ মন্ত্র স্বরুপিনী । তুমিই অমৃত রূপা এবং তুমি অ-উ-ম এই মাত্রা রুপে অবস্থিতা প্রনব রুপা । যা বিশেষ রুপে উচ্চারনের যোগ্য নয় , সেই নির্গুণা বা তুরীয়া – তাও তুমি । হে দেবী তুমিই গায়ত্রী মন্ত্র স্বরুপিনী । তুমিই পরমা জননী । হে দেবী তুমিই এই সমগ্র জগত কে ধরে রেখেছো , এই জগত তোমারই দ্বারা সৃষ্ট ও প্রতিপালিত হয় এবং সব সময় প্রলয় কালে তুমি একে গ্রাস করে থাকো বা সংহার করে থাকো । হে জগতস্বরূপা , তুমিই এই জগতের সৃষ্টির সময় সৃষ্টিরূপা , পালন কালে তুমিই স্থিতি রুপা , এবং সবসময় প্রলয়কালে তুমি সংহার রুপা । হে দেবী তুমিই তত্ত্বমসি ইত্যাদি মহাবাক্য লক্ষণা ব্রহ্মবিদ্যা ও মহামায়া । তুমিই মহতী মেধা বা ধারনা । তুমিই মহতী স্মৃতি ও মহামোহরুপিনী । তুমিই সর্ব রপিনী । তুমি দেবশক্তি আবার তুমিই অসুর শক্তি । তুমি সর্বভূতের মূল কারণ রুপা প্রকৃতি এবং গুনত্রয়ের প্রসবকারিনী । তুমিই কালরাত্রি অর্থাৎ যাতে ব্রহ্মার লয় হয় ও মহারাত্রি যাতে জগতের লয় হয় এবং ভীষন মোহরাত্রিস্বরূপা । তুমি শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মী । তুমি ঈশ্বরী শক্তি । তুমিই হ্রী । তুমিই নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি । তুমিই লজ্জা । তুমিই পুষ্টি এবং তুমিই শান্তি ও ক্ষমারূপিণী । তুমিই খড়্গ ধারিনী । তুমিই ত্রিশূলধারিণী , তুমিই ভয়ঙ্করী , গদাধারিনী , চক্রধারিনী , শঙ্খধারিনী এবং ধনুর্ধারীনি । তুমিই বাণ , ভূশন্ডী ও পরিঘ নামে অস্ত্রধারিনী । তুমিই দেবতা গনের প্রতি প্রশান্তা বা সৌম্যা । তুমিই দৈত্য গনের প্রতি অসৌম্যতরা অর্থাৎ ততোধিক রুদ্রা। তুমিই সকল সুন্দর বস্তুসমূহ থেকেও সুন্দরী । তুমিই ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । তুমিই সর্ব প্রধানা দেবী ও তুমিই পরমেশ্বরী । হে সর্বস্ব রুপে যে কোন জায়গায় বা স্থানে যে কোন চেতনা বা জড় বস্তু অতীতে ছিল , বর্তমানে আছে , এবং ভব্যিষতে হবে সেই সকল যেই শক্তি তাও তুমি । অতএব কিভাবে তোমাকে স্তব করব? যিনি ব্রহ্মা রুপে জগতের সৃষ্টি করেন । বিষ্ণু রুপে জগতকে পালন করেন এবং শিব রুপে জগতকে ধ্বংস করেন , সেই পরমেশ্বরকেই তুমি নিদ্রায় অভিভূত করেছ । সুতরাং এই জগত সংসারে তোমার স্তব করার সাধ্য কার আছে ? তুমি আমাকে , বিষ্ণুকে এবং শিবকেও শরীর গ্রহণ করিয়েছ । সুতরাং কে তোমার স্তব করতে পারে ? হে দেবী , তুমিই এক রকম ভাবে নিজ অলৌকিক মহিমায় সংস্তুতা হয়ে মধু ও কৈটভ নামক এই দুর্জয় দুই অসুরকে মোহিত কর । হে দেবী তুমিই জগত স্বামী বিষ্ণুকে শীঘ্র যোগনিদ্রা থেকে জাগিয়ে এই দুই মহাসুরকে বধ করার জন্য প্রবৃত্তি দান কর । ”

এই ভাবে ব্রহ্মা দশমুখ ও দশ চরণ বিশিষ্টা পরমেশ্বরী মহাকালীর স্তব করলেন । দেবী স্তবে মুগ্ধ হয়ে ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রা ভঙ্গ করার জন্য তাঁর চোখ, মুখ, মুখ, নাসিকা , বাহু , হৃদয় এবং বক্ষস্থল থেকে নির্গত হয়ে ব্রহ্মার সম্মুখে প্রকট হলেন । ভগবান বিষ্ণু জেগে উঠলে ব্রহ্মা তাকে সব ঘটনা জানালেন । ততক্ষণে দুই অসুর ও সেখানে এসে গেছে । ভগবান বিষ্ণু সব শুনে যুদ্ধে নামলেন । ২ অসুরের সাথে ভগবান বিষ্ণুর যুদ্ধ বেধে গেলো । যুদ্ধ করতে করতে পাঁচ হাজার বছর কেটে গেল । তবুও দুই অসুর বধ হলেন না । শেষে ভগবান বিষ্ণু ও দুই অসুর ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলেন , ভগবান বিষ্ণু ভাবলেন এই দুই অসুর দেবীর কাছে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছেন । তাই এদের বধ করা অস্মভব ।

তখন ভগবান নারায়ন সেই মহামায়া কে স্তব করতে লাগলেন । দেবী প্রকট হয়ে জানালেন – “ আপনি যুদ্ধ করুন । আমি শীঘ্র মোহ বিস্তার করে ২ অসুরের বুদ্ধি ভ্রমিত করব ।”

ভগবান আবার যুদ্ধ শুরু করলে দেবী ২ অসুরকে ভ্রমিত করলেন । দুই অসুর গর্বে ভগবান বিষ্ণু কে বললেন – “ ওহে তোমার যুদ্ধ কলায় আমরা প্রসন্ন । তুমি আমাদের কাছে বর চাও ।”

ভগবান বিষ্ণু বললেন – “ তোমরা আমার হাতে বধ্য হও , এই আমার অভিলাষ ।”

দুই অসুর ও বেশ চতুর । তারা বললেল – “ তাই হবে । তবে আমরা স্থলে মরতে চাই ।”

কারন অসুর ২ জন দেখল চার পাশে খালি জল আর জল । তখন ভগবান বিষ্ণু বললেন – “ তোমরা আমার জঙহা তে আসো । আমি সেখানেই বধ করবো ।”
শুনে দুই অসুর নিজের দেহ কে সহস্র যোজন বড় করল । ভগবান বিষ্ণু তার শরীর কে তার দ্বিগুণ করলেন । তারপর ২ অসুরকে নিজ জঙ্ঘা তে রাখলেন । তারপর সুদর্শন চক্র দিয়ে মধু আর কৈটভ এর শিরোচ্ছেদ করলেন । এই ভাবে মধু আর কৈটভের অন্ত হল ।

(শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধ )


শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই দানব ছিল । তারা প্রজাপতি ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করলেন । খুশি হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা বর দিতে আসলেন । ২ দানব বর চাইলো যে , কোন পুরুষ যেনো তাদের বধ করতে না পারে । ব্রহ্মা তাদের তাই বর দিলেন । 

এর পর সেই দুই অসুর মহা ভয়ানক অত্যাচার আরম্ভ করল । তার সাথে যোগ দিল চণ্ড ও মুণ্ড নামক ২ অসুর । রক্তবীজ নামক আর এক অসুর এসে যোগ দিল । রক্তবীজ ব্রহ্মার কাছে বর পেয়েছিলেন যে তার রক্ত মাটিতে যেখানেই পরবে সেখানেই দ্বিতীয় রক্তবীজ তৈরি হবে । 

অসুর দের অত্যাচারে ধর্ম কর্ম লোপ পেল । মুনি ঋষি দের কারাগারে বা তাদের বধ করা হল । অনেক কন্যা রা দানব দের হাতে লাঞ্ছিতা হলেন । অনেক রাজা তাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করল । এভাবে পৃথিবী বিজয় হলে অসুর রা বিশাল সেনা নিয়ে স্বর্গ আক্রমণ করল । দেবতা আর অসুর দের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হল । দেবতারা পরাজিত হয়ে স্বর্গ থেকে পলায়ন করলেন । স্বর্গে অসুরদের অধিকার কায়েম হল । পরাজিত দেবগণের দুঃখের সীমা থাকল না। আর ব্রহ্মার বর এর জন্য বিষ্ণু বা মহেশ্বর কেঊ ওই অসুরদের বধ করতে পারবেন না । ভাবতে ভাবতে দেবতাদের মাথায় এল , ভগবতী বর দিয়েছিলেন যে , বিপদে তাকে স্মরণ করলেই তিনি আবির্ভূতা হবেন । ভাবামাত্র দেবতারা হিমালয় এ গিয়ে দেবীর স্তব করতে লাগলেন । 

দেবতাদের স্তব

“ দেবীকে , মহা দেবীকে প্রনাম । সতত কল্যাণময়ী দেবী শিবাকে সতত প্রনাম করি । সৃষ্টিশক্তিরুপিনী ভদ্রাকে প্রনাম । আমরা একাগ্র চিত্তে তাঁকে বার বার প্রনাম করি । রৌদ্রাদেবীকে , নিষ্ঠদেবীকে প্রনাম , গৌরী দেবীকে , জগদ্ধাত্রী দেবীকে প্রনাম করি । জ্যোৎস্নারুপিনী , চন্দ্ররুপিনী মুখস্বরূপাকে সতত প্রনাম করি । কল্যাণীকে প্রনাম করি । বুদ্ধিরুপা ও সিদ্ধিরুপাকে পুনঃ পুনঃ প্রনাম করি , অলক্ষ্মীরূপা , রাজগণের লক্ষ্মীরূপা এবং শিবশক্তিরুপিনী তোমাকে বার বার প্রনাম করি । দুস্তর ভবসাগর পারকারিনী দুর্গাদেবীকে প্রনাম করি । যিনি সারভূতা , সর্বজননী , খ্যাতিরুপিনী এবং যিনি কৃষ্ণাবর্না ও ধুম্রবর্ণা সেই দেবীকে সতত ভক্তি ভরে প্রনাম করি । যিনি বিদ্যা রুপে অতি সৌম্যা এবং আশ্রয়রুপিনী ও ক্রিয়ারুপিনী দেবীকে বারবার প্রনাম করি । যে দেবী সকল প্রানীতে বিষ্ণুমায়া নামে শব্দিতা বা অভিহিতা হন , তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকল প্রানীতে বুদ্ধিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে নিদ্রারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকলভূতে ক্ষুধারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে ছায়ারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকলভূতে শক্তিরুপে অধিষ্ঠিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকল প্রানীতে বিষয় বাসনা রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকল প্রানীতে ক্ষমা রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে জাতিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে লজ্জারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে শান্তিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে শ্রদ্ধারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে কান্তিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে লক্ষ্মী রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে বৃত্তি বা জিবীকা রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে স্মৃতিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে দয়ারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে তুষ্টি রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে মাতৃরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে ভ্রান্তিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যিনি সমস্ত প্রানীর মধ্যে ইন্দ্রিয়গনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতারুপে বিরাজিতা এবং যিনি ক্ষিতি , অপ্ , তেজ , মরুৎ ও ব্যোম , পঞ্চভূতের প্রেরায়িত্রী , সেই বিশ্ব ব্যাপিকা দেবীকে পুনঃ পুনঃ প্রনাম করি । যিনি চিৎশক্তি রুপে এই সারা জগত জুড়ে অবস্থান করছেন তাকে প্রনাম প্রনাম প্রনাম । ”

এই ভাবে দেবতারা দেবী ভবানীর স্তব করতে লাগলেন । সে সময় সেখানে দেবাদিদেব মহেশ্বরের পত্নী ভগবতী পার্বতী তাদের সামনে দিয়ে গঙ্গা স্নানের জন্য যাচ্ছিলেন । দেবী তাদের স্তব শুনে বললেন – “ আপনারা এখানে কার স্তব করিতেছেন ? ”

সেই সময় ভগবতী পার্বতীর শরীর থেকে তার মতন দেখতে আর এক জন দেবী বের হয়ে আসলেন । সেই নব আবির্ভূতা দেবী জানালেন – “ ইহারা আমারাই স্তব করিতেছেন ।”

এই দেবীই আদ্যাশক্তি জগত মাতা অম্বিকা মহামায়া । তিনি দেবী পার্বতীর কোষ থেকে সৃষ্টি হয়েছেন বলে তার এক নাম কৌষিকী । কথিত আছে এর পর নাকি দেবী পার্বতী কৃষ্ণবর্ণা হয়ে যান । এবং তিনি কালিকা নামে প্রসিদ্ধা হলেন । 

দেবতারা দেবী মহামায়ার কাছে অসুর দের অত্যাচার এর কথা বিস্তারে জানালেন । দেবী অম্বিকা তাদের অভয় দিয়ে জানালেন , তিনি অসুর দের নাশ করবেন । 

দেবী হিমালয়ে সিংহ পৃষ্ঠে বসে মধু পান করতে লাগলেন । সে সময় চণ্ড আর মুণ্ড নামক দুই দানব দেবীকে দেখতে পেলেন । চন্ড মুন্ড একথা গিয়ে শুম্ভ নিশুম্ভ কে জানালেন । শুম্ভ , নিশুম্ভ সেই নারীর রুপ বর্ণনা শুনে সেই নারীকে পাবার জন্য আকুল হল । নারী লোলুপতা , কামান্ধতা আসুরিক প্রবৃত্তির আর একটি লক্ষণ । শুম্ভ নিশুম্ভ সেই নারীকে পাবার জন্য সুগ্রীব নামক এক অসুর কে পাঠালো । ঠিক হল সুগ্রীব সেই নারী কে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসবে । 

সুগ্রীব হিমালয়ে সেই পর্বত চূড়ায় গিয়ে দেবীকে শুম্ভ নিশুম্ভের পরাক্রম , ঐশ্বর্য এর কথা বলে বিবাহের প্রস্তাব দিল । দেবী শুনে ঈষৎ হাস্য করে বললেন – 
“ শুম্ভ ত্রিভুবনের অধিপতি এবং নিশুম্ভ তারই মতো বীর । কিন্তু এ বিষয়ে আগেই আমি আমার অল্প বুদ্ধিবশতঃ যে প্রতিজ্ঞা করেছি , তার অন্যথা করি কি করে ? আমার প্রতিজ্ঞাটি শোন – যিনি আমাকে যুদ্ধে জয় করবেন , যিনি আমার দর্পচূর্ণ করবেন – এবং যিনি জগতে আমার তুল্য বলশালী হবেন – তিনিই আমার স্বামী হবেন । অতএব মহাসুর শুম্ভ অথবা নিশুম্ভ এখানে এসে আমাকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে শীঘ্র আমাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করুন এ বিষয়ে আর দেরীর কি দরকার ?”

দূত জানালেন এটি নিছক উপহাস মাত্র । শুম্ভ ও নিশুম্ভ এর মতো মহা পরাক্রমী ব্যাক্তি আপনার মতো দুর্বলা , অবলা নারীর সাথে কিভাবে যুদ্ধ করবেন ? আপনি চলুন নচেৎ পরে আপনাকে অপমান করে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যাবে । 

দেবী জানালেন – “ আমি বিচার বুদ্ধি করে প্রতিজ্ঞা করিনি । অতএব তুমি ফিরে গিয়ে তোমার রাজা শুম্ভাসুর কে সব জানাও । তারপর তিনি যা উচিত মনে করবেন – তাই করবেন ।”

( ধুম্রলোচন বধ )

শুম্ভ ও নিশুম্ভ তার দূত সুগ্রীব এর মুখে এসব কথা শুনে অতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন । অসুররাজ শুম্ভ তখন তার সেনাপতি ধুম্রলোচন কে আদেশ দিলেন – “ তুমি নিজ সৈন্যে পরিবৃত হয়ে সেই গর্বিতা নারীকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে এখানে নিয়ে আসো । আর যদি তোমাকে কেউ এ কাজে বাধা দেয় , তাহলে সেই বাধা দানকারী কে তখুনি বধ করবে ।”

এখানে বলা প্রয়োজন নারী অপহরণ একটি আসুরিক প্রবৃতি । আর কোন নারীকে কেশ আকর্ষণ করে নিয়ে আসা আর একটি আসুরিক প্রবৃতি । দুঃশাসন একবস্ত্রা রজঃস্বলা দ্রৌপদী কে কেশ আকর্ষণ করে রাজসভায় নিয়ে এসেছিল । এই পাপেই গোটা কৌরব কূল ধ্বংস হয় । নারী নির্যাতন কারীকে ঈশ্বর ও ক্ষমা করেন না । যাই হোক , ধুম্রলোচন ষাট হাজার সৈন্য নিয়ে দেবীকে আনতে গেল । 


ধুম্রলোচন দেবীকে কাছে গিয়ে বললেন – “আজ যদি আপনি নিজের ইচ্ছায় আমার প্রভু শুম্ভের নিকট না যান তবে আমি আপনাকে কেশ আকর্ষণ করে বলপূর্বক নিয়ে যেতে বাধ্য হব ।”

দেবী বললেন – “ তুমি দৈত্যরাজ শুম্ভ দ্বারা প্রেরিত , বলবান ও সৈন্য পরিবৃত । তুমি যদি আমাকে এভাবে জোর করে নিয়ে যাও , তাহলে আমি আর তোমাকে কি করতে পারি ?”

দেবীর এই কথাই শুনে ধুম্রলোচন দেবীকে ধরতে গেলো । দেবী এই দেখে এক হুঙ্কার দিলেন । সেই হুঙ্কার এই ধুম্রলোচন ভস্ম হয়ে গেল । এর পর দেবীর বাহন পশুরাজ সিংহ প্রচন্ড গর্জন করে কেশর দুলিয়ে অসুর সেনা গনের মধ্যে প্রবেশ করল । তার পর আচরে কামড়ে অসুর দের রক্ত মাংস খেতে লাগল । কাউকে মাথা ছিন্ন করল , কারোর হাত পা বিচ্ছিন্ন করল , কারোর উদর ছিড়ে রক্ত মাংস ভক্ষণ করল , কারোর গোটা শরীর শত টুকরো করে দিল । এভাবে একা সিংহ সমস্ত অসুরদের বিনাশ করল ।


চণ্ড ও মুন্ড বধ )

শুম্ভ ও নিশুম্ভ সব শুনে অতিশয় বিস্মিত হলেন । কারন এক নারীর পক্ষে ধুম্রলোচন এর মতো মহাবীর কে বধ করা সাধারন ব্যাপার নয় । তারা চণ্ড ও মুন্ড নামক ২ দানব কে পাঠালেন । 

চন্ড ও মুণ্ড বহু সেনা , অশ্ব , রথ , হাতী নিয়ে যুদ্ধে আসল । তারা হিমালয়ের চূড়ায় হাস্যরত দেবী অম্বিকা কে দেখতে পেলেন । দেবী চন্ডিকা তাদের দেখে ভীষণ ক্রুদ্ধা হলেন । ক্রোধে তার বদন মণ্ডল কৃষ্ণবর্ণা হল । দেবী ভ্রুকূটি কুঞ্চিত করলেন । তখন দেবীর ললাট থেকে এক বিকট দর্শনা দেবী প্রকট হলেন । সেই দেবী কালিকা । তিনি বিচিত্র নর কঙ্কাল ধারিনী , নরমুণ্ড মালিনী , ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা , অস্থি চর্মসার দেহ স্বরূপা । অতি ভীষনা , বিশাল বদনা , লোলজিহ্বা , ভয়ঙ্করী , কোটর গতা , আরক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং সিংহ নাদে দিক মণ্ডল পূর্ণ কারিনী । 


সেই ভয়ংকরা দেবী ভীষন হুঙ্কার দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন । সেই দেবী প্রচুর অসুর সেনাকে মূঠে মূঠে তুলে চিবিয়ে খেতে লাগলেন । অসুরেরা যত অস্ত্র দেবীর পানে নিক্ষেপ করল , দেবীর শরীরে লাগতেই অস্ত্র গুলো ভেঙ্গে যেতে লাগল । দেবী হাজারে হাজারে অসুর সেনাদের ভক্ষণ করতে লাগলেন । রথ , অশ্ব , হাতী গুলোকে ধরে মুখে নিয়ে তা চিবিয়ে খেতে লাগলেন । রক্তে তার দন্ত গুলি লাল হয়ে গেল । কত গুলি অসুরকে দেবী তার চরণ ভারে পিষে বধ করলেন । কোন কোন অসুর দেবীর খড়গের আঘাতে মারা গেল । আবার কিছু অসুর দেবীর দাতে চর্বিত হয়ে মারা গেলো । যুদ্ধক্ষেত্রে এই ভাবে দেবী অসুর দের ধ্বংস করে ফেললেন ।

এ দেখে চণ্ড অসুর হাজার হাজার চক্রাস্ত্র নিক্ষেপ করে দেবীকে আচ্ছন্ন করে ফেললেন । বাণের প্রভাবে সূর্য ঢাকা পড়ল । দেবী তখন তার খড়গ তুলে ‘হং’ শব্দ করে চন্ডের দিকে ধেয়ে গেল । দেবী চন্ডের চুলের মুঠি ধরে এক কোপে চণ্ডের শিরোচ্ছেদ করে ফেললেন । চন্ড অসুর বধ হল ।

চন্ড নিহত হয়েছে দেখে ক্রোধে মুন্ড দেবীর দিকে ধেয়ে গেলো । দেবী তার রক্তাক্ত খড়গ দিয়ে আর এক কোপে মুন্ড এর শিরোচ্ছেদ করলেন । এভাবে মুণ্ড বধ হল । বাদবাকী জিবীত অসুর রা এ দেখে ভয়ে পালালো । দেবতারা আনন্দে দেবীর জয়ধ্বনি করলেন ।

দেবী চন্ড আর মুণ্ড এর ছিন্ন মস্তক নিয়ে দেবী মহামায়ার কাছে এসে বিকট অট্টহাসি হেসে বললেন – “ এই যুদ্ধরূপ যজ্ঞে আমি আপনাকে চন্ড ও মুন্ড নামে দুই মহাপশুর মস্তক উপহার দিলাম । এখন আপনি নিজেই শুম্ভ ও নিশুম্ভ কে বধ করবেন ।”

দেবী অম্বিকা মধুর স্মরে বললেন – “ হে দেবী , যেহেতু তুমি চন্ড ও মুণ্ডের বধ করে মাথা দুটি আমার নিকট নিয়ে এসেছো , সেজন্য আজ থেকে তুমি জগতে ‘চামুন্ডা’ নামে বিখ্যাত হবে ।”

( রক্তবীজ বধ )


ইতিমধ্যে দেবীর ইচ্ছায় মহেশ্বর দূত হয়ে অসুর দের বোঝাতে গেলেন । দেবী শিবশম্ভু কে দূত হিসাবে পাঠালেন বলে দেবীর এক নাম হল শিবদূতী । মহাদেব অসুর দের অনেক বোঝালেন কিন্তু অসুর রা শুনলো না । অসৎ ব্যাক্তি কখনো ধর্ম কথা শোনে না । চন্ড ও মুন্ডের নিধন সংবাদ পেয়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভ ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল । 

শুম্ভাসুরের আদেশে ৮৬ জন প্রধান দৈত্য তাদের সেনা সহ , কম্বু বংশ জাত ৮৪ জন দৈত্য তাদের সেনা সহ , কোটিবীর্য নামে অসুর দের ৫০ টি বংশ , ধুম্র বংশের অসুর দের ১০০ বংশ সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রা করল । কালক , দৌ্হৃরদ , মৌর্য , কালকেয় অসুর রা যুদ্ধে প্রস্থান করল । 

অসুর দের পদভরে পৃথিবী কাপতে লাগল । ধূলা বালি উড়িয়ে লক্ষ লক্ষ ঘোড়া রথ ছুটে চলল । হস্তীবাহিনীর পদ চাপে মেদিনী দুলতে লাগল । অসুর রা বিবিধ বাজনা , দুন্দভি , শিঙা বাজিয়ে নানা ভাবে গর্জন করে প্রানঘাতক অস্ত্র গুলি নাচাতে নাচাতে চলল । ঘন ঘন রনদামামা , রনভেরী বাজতে লাগল । 

অসুর দের আসতে দেখে দেবী মহামায়া শঙ্খধ্বনি , ঘণ্টাধ্বনি করতে লাগলেন । তার ধ্বনি দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ল । দেবীর ধনুষ্টঙ্কার এ চারপাশ কেপে উঠল । পশুরাজ সিংহ ঘন ঘন কেশর ও লেজ দুলিয়ে ভয়ানক গর্জন করতে লাগলেন । 

এসময় ব্রহ্মার থেকে হংসযুক্ত বিমানে জপমালা ও কমুন্ডল নিয়ে দেবী ব্রহ্মাণী আসলেন । মহেশ্বর এর থেকে ষাঁড় এর পীঠে চেপে ত্রিশূল নিয়ে আসলেন । তার পরনে ব্যাঘ্রচর্ম , কপালে অর্ধচন্দ্র , অঙ্গে সর্প । দেবীর নাম মহেশ্বরী । কার্তিক এর থেকে দেবী কৌমারী দেবী প্রকট হয়ে আসলেন , যিনি ময়ূরবাহনা ও হস্তে তির আর ধনুক । শ্রী নারায়নের থেকে প্রকট হয়ে আসলেন বৈষ্ণবী শক্তি , যার হাতে চক্র , শঙ্খ , গদা , পদ্ম , ধনুক-বান , খড়গ । ইনি গরুর পক্ষী বাহনা । বারাহী দেবী আসলেন । নারসিংহী দেবী আসলেন । তারপর ১০০ চক্ষু বিশিষ্টা হস্তী বাহনা ঐন্দ্রী দেবী বজ্র নিয়ে আসলেন । শিবদূতী ও কালিকা দেবী আসলেন । 

রক্তবীজ প্রচুর সৈন্য সামন্ত নিয়ে আসলে দেবী মহামায়া , কালিকা কে বললেন – “ আমার প্রীতির জন্য আপনি সত্বর অসুর দের বিনাশ করুন ।”

দেবী কালিকার থেকে অসংখ্য দেবীগণের সৃষ্টি হল । অসুর রা এসে দেবী কালিকা কে বাণ দ্বারা আছন্ন করলে দেবী ভীষণ তান্ডব শুরু করলেন । তিনি তার তীব্র খড়গ দ্বারা দানব দের শিরোচ্ছেদ করতে লাগলেন , চরণে পিষ্ট করে বধ করতে লাগলেন , কাউকে আবার গিলে খেয়ে ফেললেন । দেবী মহামায়া চক্র শূল , বাণ , খড়গ , গদা , কুঠার দ্বারা অসুর দের ধ্বংস করতে লাগলেন । 

ব্রহ্মাণী দেবী কমুন্ডল এর জল ছিটিয়ে অসুর দের ভস্ম করতে লাগলেন । বৈষ্ণবী দেবী চক্র দিয়ে অসুর দের টুকরো টুকরো করে দিলেন । তাঁর গদার আঘাতে অসুর রা রক্তবমি করতে করতে মারা গেল । রথ , অশ্ব , হস্তী গুলো ধ্বংস হল । কৌমারী দেবীর ভীষন বানবৃষ্টি তে অসুর দের দেহ গুলো টুকরো টুকরো হতে লাগল । ঐন্দ্রী দেবীর বজ্র প্রহারে অসুরেরা ভস্ম হতে লাগল । বারাহী দেবী তার তীক্ষ্ণ দন্তের দ্বারা অসুর দের ছিড়ে ফেলতে লাগলেন । নারসিংহী দেবী তার নখ দ্বারা অসুর দের ছিন্নবিচ্ছিন্ন করলেন । শিবদূতী দেবীর অট্টহাস্যে অসুর রা মূর্ছিত হলে দেবী সেই মূর্ছিত অসুর দের গিলে খেলেন । দেবীর বাহন সিংহ অসুর দের আঁচরে কামরে শেষ করতে লাগলেন । 

রক্তবীজ এ দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে আসলেন । । রক্তবীজ ব্রহ্মার কাছে বর পেয়েছিলেন যে তার রক্ত মাটিতে যেখানেই পরবে সেখানেই দ্বিতীয় রক্তবীজ তৈরি হবে । রক্তবীজ প্রথমেই দেবী ঐন্দ্রীর সাথে যুদ্ধ করলেন । ঐন্দ্রী দেবীর ব্জ্রপ্রহারে ক্ষতবিক্ষত হলে তার শরীর থেকে অনেক বিন্দু রক্ত পড়ে আরো রক্তবীজ এর সৃষ্টি হল । এভাবে অনান্য দেবী দের অস্ত্রের আঘাতে রক্তবীজ রক্তাক্ত হলে অনেক রক্তবীজ এর সৃষ্টি হল । দেবতারা এ দেখে খুব ভয় পেলেন । 

দেবী অম্বিকা তখন কালিকাকে বললেন – “ হে চামুন্ডে , তুমি শীঘ্র তোমার বদন বিস্তৃত কর । এবং তোমার ওই বিস্তৃত মুখ দিয়ে আমার শস্ত্রের আঘাতে রক্তবীজের শরীর থেকে যে রক্তবিন্দু ঝরবে তা খেয়ে ফেলবে । সেই সঙ্গে ওই রক্তবিন্দু থেকে জন্মলাভ করা অসুর দের খেতে খেতে তুমি সারা যুদ্ধক্ষেত্র ঘুরে বেড়াও । তাহলেই এই রক্তবীজ দৈত্য ক্রমশঃ রক্তশূন্য হয়ে পড়বে । আর তাতেই তার ক্ষয় বা মৃত্যু হবে । পরন্তু তুমি দৈত্যদের খেয়ে ফেলতে থাকলে আর উগ্র দৈত্যদের জন্ম হবে না । ”

দেবী অম্বিকা এই বলে নিজের শাণিত ত্রিশূল দিয়ে রক্তবীজ কে আঘাত করলেন । দেবী কালিকা রক্তবীজের রক্ত খর্পর ( করোটি ) এ নিয়ে পান করলেন । এই ভাবে অম্বিকার ত্রিশুলে রক্তবীজ ভীষন ভাবে আহত হল । তার এক বিন্দু রক্ত মাটিতে পরল না । দেবী কালিকা তার সমস্ত রক্ত পান করলেন । এভাবে রক্তবীজ এর সমস্ত রক্ত দেবী কালিকা পান করলে রক্তবীজের মৃত্যু হল । 

এর পর দেবী কালিকা সমস্ত যুদ্ধখেত্র ঘুরে বেড়ালেন আর রক্তবীজ এর দেহ থেকে সৃষ্টি হওয়া অনান্য রক্তবীজ দের খড়গ দ্বারা শিরোচ্ছেদ করে তাদের রক্ত পান করতে লাগলেন । রক্তপান করতে করতে দেবী ভয়ানক হয়ে উঠলেন । তাহার জিহ্বা ও দন্ত রক্তবর্ণ হল । এভাবে সমস্ত রক্তবীজ দের নাশ হল । দেবী কালিকার অট্টহাস্যে চারিদিক পরিপূর্ণ হল । দেবীর হাতে অসুর , হস্তী , অশ্ব , রথ ধ্বংস হতে লাগল । 

শেষে এমন হল দেবী কালিকা পলায়মান অসুর দের বধ করে তাদের রক্ত পান করতে লাগলেন । দেবী মহামায়ার ডাকেও তিনি ফিরলেন না । দেবতাগন দেবীকে শান্ত করার জন্য অনেক স্তব স্তুতি করলেও দেবী শান্ত হলেন না । উপায় না দেখে দেবগণ মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন । মহাদেব শব রুপ হয়ে দেবী কালিকার যাত্রাপথে শুয়ে থাকলেন । দেবী কালিকা মহাদেব কে দেখতে পেলেন না । তিনি তাঁর ডান চরণ মহাদেবের বুকে রাখলেন । যখন তিনি নীচে তাকিয়ে দেখলেন স্বয়ং স্বামী মহাদেব , তখন তিনি লজ্জায় তার জিহ্বা বের করলেন ।এর পর দেবী কালিকা শান্ত হলেন।



(দেবীর হাতে মহিষাসুরের সেনাদের বধ)

মহিষাসুরের অসুর বাহিনী রথ, পদাতিক , হাতী , অশ্ব বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে ধাবমান হল । সেনাপতি চিক্ষুর , চামর রথ , গজ , পদাতিক , অশ্ব চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে যুদ্ধে গেলো । ষাট হাজার রথ নিয়ে উদগ্র নামক অসুর এবং এক কোটি রথ নিয়ে মহাহনু নামক অসুর আসলো । বাস্কল নামক অসুর ষাট লক্ষ রথ , অসিলোমা ৫ কোটি রথ নিয়ে আসলো । বিড়ালাক্ষ নামক অসুর ৫০০ রথে পরিবেষ্টিত হয়ে যুদ্ধে আসল ।
অনান্য অসুর রা নানা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে আসল । মহাযুদ্ধ শুরু হল । অসুরেরা নানা অস্ত্র শস্ত্র বর্ষণ করতে শুরু করল ।

ভগবতী মহামায়া নানা অস্ত্র প্রয়োগ করে অসুর দের অস্ত্র গুলি ধ্বংস করতে লাগলেন । দেবী তার প্রচণ্ড অস্ত্র দ্বারা দানব দের বধ করতে লাগলেন ।
দেবীর বাহন পশুরাজ সিংহ ভয়ানক গর্জন করে রন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে অসুরদের ওপর আঘাত হানলো । সিংহ তার নখ দন্ত দিয়ে অসুরদের মেরে রক্ত মাংস খেতে লাগল । অসুর দের কারো মুন্ড কাটা গেলো, কারোর শরীর রক্তাক্ত ও অর্ধেক হয়ে গেলো ।
দেবী চক্র , বাণ , ত্রিশূল , গদা , কুঠার দিয়ে অসুরদের বধ করতে লাগলেন । দেবীর চক্রে অসুর রা খন্ড বিখন্ড হতে লাগল । শূল বিদ্ধ হল । গদার আঘাতে রক্তবমি করতে করতে দানব রা প্রান ত্যাগ করতে লাগলো । দেবীর খড়গে কিছু অসুরদের মাথা কাটা গেল । কারোর হাত কাটা পরল । কারোর দেহ আড়াআড়ি ভাবে অর্ধেক হল । দেবীর বানে অসুরেরা মরতে লাগল । কারোর মুণ্ড উড়ে গেলো । কারোর হাত পা কাটা পড়লো । যুদ্ধ ভূমি রক্তে ভেসে গেলো । সিংহ এর দাত নখ অসুরদের রক্তে লাল হয়ে গেল । দেহের স্তূপ জমে গেলো । দেবী র অস্ত্রে রথ , হস্তী , অশ্ব টুকরো টুকরো হতে লাগলো । এই ভাবে দেবী ভবানী অসুরদের নিধন করতে লাগলেন ।

চিক্ষুর কে দেবী ত্রিশূল দ্বারা বধ করলেন । চামর অসুর যুদ্ধ করতে আসলে দেবীর বাহন সিংহ তাকে কামড় বসিয়ে তার গলা থেকে মুন্ড টা আলাদা করে দিলো । এর পর দেবী উদগ্র ও করাল নামক অসুরকে বধ করলেন । গদার প্রহারে উদ্ধতাসুর কে বধ করলেন । তারপর বাণ এর আঘাতে তাম্র অসুর ও অন্ধক নামক অসুরকে বধ করলেন । ত্রিশুল দিয়ে উগ্রাস্য , উগ্র বীর্য , মহাহনু নামক অসুরকে বধ করলেন । এর পর দুর্ধর ও দুর্মুখ নামক ২ অসুরকে তরবারি দিয়ে বধ করলেন । নিজের সেনা দের ধ্বংস হতে দেখে মহিষাসুর যুদ্ধে আসলেন ।


( মহিষাসুর এর যুদ্ধে আগমন)

মহিষাসুর যুদ্ধে এসে ভীষণ সংগ্রাম আরম্ভ করলেন । দেবী নানা অস্ত্রে মহিষের অস্ত্র গুলিকে ধ্বংস করতে লাগলেন । মহিষাসুর তার শিং দিয়ে পাহার গুলিকে দেবীর দিকে ছুড়তে লাগলেন । তার লেজের আঘাতে সমুদ্র উথলে উঠতে লাগল । দেবী চন্ডীকা তখন পাশ নিক্ষেপ করে মহিষাসুর কে বেঁধে ফেললেন । মহিষাসুর তখন মহিষ রুপ ছেড়ে সিংহ রুপ ধরলেন । দেবী খড়গ দিয়ে সেই সিংহ এর মাথা কাটলেন । তখন মহিষাসুর একটি খড়গ ঢাল ধারী পুরুষ মূর্তি ধারন করলেন । দেবী বান বর্ষণ করে সেই পুরুষ ও তার ঢাল খড়গ কে ছিন্ন বিছিন্ন করলেন । এর পর মহিষাসুর হস্তী রুপ ধরলেন । শুঁড় দিয়ে দেবীর বাহন কে পেঁচিয়ে ধরে টানতে লাগলেন । দেবী খড়গ দিয়ে সেই শুঁড় কেটে ফেললেন । তখন মহিষাসুর পুনরায় মহিষ মূর্তি ধরে দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন । দেবী মহামায়া তখন দিব্য সুরা পাত্র থেকে মধু খেতে লাগলেন । মহিষাসুর তখন গর্বে উদ্ধত হয়ে গর্জন করতে লাগলেন ।

দেবী মহামায়া তখন বললেন – “ ওরে মূঢ় , যতক্ষণ আমি মধু পান করি , ততক্ষণ তুই গর্জন কর । আমি তোকে বধ করলে ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতা গন এখানেই এখুনি আনন্দধ্বনি করবেন । ”

এর পর দেবী এক লাফ দিয়ে মহিষাসুরের পীঠের ওপর তার গলাটি পায়ের দ্বারা চেপে ধরলেন । তারপর দেবী তার শূল দিয়ে মহিষাসুরের বুক বিদ্ধ করলেন । তার পর মহিষাসুরের মুখ দিয়ে আর একটি মহাসুর বের হতেই দেবী তার খড়গ দিয়ে সেই অসুরের মাথা কেটে ফেললেন । এই ভাবে মহিষাসুর এর বধ হল । দেবতারা আনন্দিত হলেন । অবশিষ্ট অসুর সেনাগন হায় হায় করতে করতে পালিয়ে গেলো ।

ত্রিলোকে মঙ্গল বাদ্য বেজে উঠলো । সকলে আদিশক্তির স্তব করতে লাগলেন । অপ্সরা , গন্ধর্ব , কিন্নর রা নৃত্যগীত করতে লাগলেন । স্বর্গ রাজ্য তে আবার দেবরাজ ইন্দ্র ও দেবতাগন পুনধিষ্ঠিত হলেন । পৃথিবী তে শান্তি নেমে আসলো । ঋষি মুনিরা আনন্দে ধর্মাচরণ করতে লাগলেন ।


(দেবতাগন এর স্তবস্তুতি)

দেবী মহামায়া কে সকল এ স্তব করতে লাগলেন

“ যে দেবী আপন শক্তির প্রভাবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পরিব্যাপ্তা হয়ে আছেন , যিনি সমস্ত দেবতাগনের ঘনীভূতা মূর্তিস্বরূপা , যিনি দেবতা ও মহর্ষিগনের আরাধ্যা , সেই জগতের মাতা অম্বিকা দেবীকে আমরা ভক্তিপূর্বক প্রনাম করছি । তিনি আমাদের সকল রকম মঙ্গল বিধান করুন । বেদে ভগবান বিষ্ণুকে সহস্রবদন । সেই সহস্রবদন বিষ্ণু , ব্রহ্মা , শিব যাঁর অতুলনীয় প্রভাব ও শক্তি বর্ণনা করতে সমর্থ নন , সেই দেবী চন্ডীকা সমগ্র বিশ্ব প্রতিপালনের জন্য এবং আমাদের অমঙ্গলজনক ভয় বিনাশের জন্য ইচ্ছা করুন । যিনি স্বয়ং পুন্যবান ব্যাক্তিদের গৃহে লক্ষ্মীস্বরূপা এবং পাপাচারী লোকেদের গৃহে অলক্ষ্মীস্বরূপা , যিনি শুদ্ধচিত্ত ব্যাক্তিগনের হৃদয় এ সদ্ বুদ্ধি স্বরূপা ও সজ্জনগনের লজ্জারুপা , সেই তোমাকে আমরা ভক্তিভরে প্রনাম করি । হে দেবি , তুমি সমগ্র জগত প্রতিপালন কর । হে দেবী , দেবতা , দৈত্য , প্রমথ ও ব্রহ্মর্ষিগনের মধ্যে আপনার এই অনিবার্য ও অচিন্তনীয় স্বরূপ তোমার অসুর নাশকারী অসীম মহাবীর্য , সংগ্রামে তোমার এই অতি অদ্ভূত আচরণসমূহ আমরা কি প্রকারে বর্ণনা করব? তুমি সম্যক জগতের মূল কারণ । তুমি সত্ত্ব প্রভৃতি ত্রিগুণময়ী হলেও রাগ , দ্বেষ যুক্ত ব্যাক্তিগন তোমাকে জানতে পারে না । এমনকি তুমি বিষ্ণু ও শিব প্রভৃতি দেবতাদের অজ্ঞাত । তুমিই সকলের আশ্রয়স্বরূপা । ব্রহ্মা থেকে কীট পর্যন্ত এই অখিল বিশ্ব তোমার একাংশ মাত্র । কারণ তুমিই ত সকলের আশ্রয় স্বরূপা । তুমিই বিকার রহিতা পরমা আদ্যা প্রকৃতি । হে দেবী , যে মন্ত্রের সম্যক উচ্চারণে সকল দেবতাবৃন্দ তৃপ্তিলাভ করেন সেই স্বাহামন্ত্র তুমিই এবং পিতৃগনের তৃপ্তির স্বধামন্ত্র তো তুমিই । এজন্যই দেবযজ্ঞ ও পিতৃযজ্ঞ অনুষ্ঠানকারী সকল ব্যাক্তিগন স্বাহা ও স্বধা মন্ত্ররূপে উচ্চারন করে থাকেন । হে দেবী , যে পরাবিদ্যা মুক্তির কারণ , যোগশাস্ত্রে বর্ণিত দুঃসাধ্য যম নিয়ম প্রভৃতি মহাব্রত যার সাধন – তুমিই সেই ভগবতী পরমা ব্রহ্মবিদ্যা । সেজন্য যারা জিতেন্দ্রিয় তত্ত্বনিষ্ঠ , সমস্ত দোষবর্জিত , শুদ্ধচিত্ত ও মুমুক্ষু সেই মুনিগন তোমার সাধনা করে থাকেন । হে দেবী । তুমিই শব্দ ব্রহ্মস্বরূপিণী । তুমিই বিশুদ্ধ ঋক ও যজুঃ মন্ত্রসমূহের এবং উদাত্তদি স্বর ও মধুর পদোচ্চারন বিশিষ্ট সামমন্ত্র
সমূহের আশ্রয় । তুমি বেদত্রেয় রুপিনী ও সর্ব ঐশ্বর্যময়ী দেবী ভগবতী । তুমিই জগত সংসার পালনের জন্য কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি বৃত্তি স্বরূপা এবং সারা জগতের পরম দুঃখ বিনাশকারিনী । হে দেবী যাঁর কৃপায় সর্ব শাশ্ত্রের মর্ম অবগত হওয়া যায় – তুমিই সেই মেধারুপিনী সরস্বতী । দুস্তর সংসার সমুদ্রের অদ্বিতীয়া তরণী স্বরূপা দুর্গাও তুমি । তুমিই নারায়নের হৃদয় বিহারিনী লক্ষ্মীদেবী এবং তুমিই মহাদেবের হৃদয় বিলাসিনী দেবী গৌরী । হে দেবী , তোমার ঈষৎ হাস্যময় , নির্মল , পূর্ণচন্দ্রের মত এবং উত্তম স্বর্ণ প্রভাতুল্য বদন মণ্ডল দেখেও মহিষাসুর ক্রোধভরে হটাত প্রহার করল – এ ঘটনা অত্যন্ত আনন্দের । হে দেবী , তোমার কুপিত , ভ্রকুটি ভীষণ নব উদিত পূর্ণচন্দ্রের তুল্য প্রভা সমন্বিত বদন মণ্ডল দেখেও মহিষাসুর সাথে সাথে প্রান ত্যাগ করেনি এ বড়ই আশ্চর্যের বিষয় ! কারন কুপিত যমকে দেখে কেউ কি বাঁচতে পারে ? হে দেবী , তুমি প্রসন্না হও । কারন তুমিই জগতের কল্যাণকারিনী । তুমিই প্রসন্না হলেই জগতের কল্যাণ হয় । আর তুমি যদি তার বিপরীত হও । অর্থাৎ ক্রুদ্ধা হও তাহলে বংশ সমূহ নষ্ট হয় । ”

দেবতারা আরো বললেন
“ দেবী তোমার শূলের দ্বারা আমাদের রক্ষা কর । হে অম্বিকে তোমার খড়গ দ্বারাও আমাদের রক্ষা কর । হে চন্ডীকে , হে ঈশ্বরী , তোমার শূলকে সঞ্চালিত করে আমাদের পূর্বদিকে রক্ষা কর । পশ্চিম ও উত্তর এবং দক্ষিণ দিকেও রক্ষা কর । ত্রিভুবনে তোমার যে সকল সৃষ্টি – স্থিতি কারিনী সৌম্যমূর্তি এবং সংহার কারিনী রুদ্রমূর্তি বিরাজিত তাদের দ্বারা আমাদিগকে ও সমগ্র জগত বাসীকে রক্ষা কর । তোমার করপল্লবে বিরাজমান খড়গ , শূল , গদা প্রভৃতি যে সকল অস্ত্র আছে , সে সকল দ্বারা আমাদের সর্বপ্রকারে রক্ষা কর । ”

এই ভাবে দেবতারা স্তব করে ভক্তিভরে দেবীকে পূজো করলে দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের বর দিতে চাইলেন ।
দেবতারা বললেন – “ দেবী ভগবতী , আপনি আমাদের শত্রু  মহিষাসুকে বধ করেছেন , এতেই আমাদের জন্য সব করা হয়েছে । বাকী আর কিছুই নেই । তবু যদি কৃপা করে আমাদের বর দিতেই চাও , তবে আমাদের প্রার্থনা – যখনই আমরা তোমাকে বার বার স্মরণ করব , তখনই তুমিই আবির্ভূতা হয়ে আমাদের ঘোর বিপদ গুলি দূর করে দেবে । হে দেবী যে মানুষ এই স্তব দ্বারা তোমার স্তুতি করবে , আমাদের প্রতি প্রসন্না হয়ে তুমি সব সময় তাদের জ্ঞান , সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য সহ ধন , সম্পদ ও স্ত্রী পুত্রাদি বৃদ্ধি করবে ।”

দেবী মহামায়া “ তাই হোক ” বলে অদৃশ্য হলেন ।

( মহিষাসুর বধ )

পুরাকালে রম্ভ নামক এক অসুর মহাদেবের কাছে ( মতান্তরে অগ্নি দেব ) বর লাভ করে যে সে এমন একটি বলশালী পুত্র লাভ করবে যে দেবতাদের পরাজিত করতে পারবে ।
সেই রম্ভাসুরের পুত্র ছিল মহিষাসুর । সে কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছে বর লাভ করেন – সে পুরুষের অবধ্য কেবল নারীর হাতেই বধ্য হবে ।
ব্রহ্মার বর পেয়ে সেই অসুর ভয়ানক অত্যাচার আরম্ভ করল । অসুর রা ভগবানকে মানে না । মুনি ঋষি দের আশ্রম ধ্বংস করে । নিজেদের কেই ভগবান মানে । নারী অপহরণ ধর্ষণ করে । ধর্ষণ একটি আসুরিক প্রবৃত্তি । নরকাসুর প্রচুর নারীকে অপহরণ করে বিয়ে করেছিল । রাবন রম্ভা নামক অপ্সরা কে ধর্ষণ করেছিলেন । মহিষাসুর আর তার প্রবল দানব সেনাও তাই করে বেড়াতে লাগলো । পৃথিবী বিজয় হলে তারা স্বর্গ আক্রমণ করে দখল করল । দেবতাদের পরাজিত করে মহিষাসুর ইন্দ্রাসনে বসলেন । অসুর রা অপ্সরা দিগকে বন্দী করলেন । ইন্দ্র দেবের পত্নী শচী দেবী পর
মা সুন্দরী । মহিষাসুর হাত থেকে বাচার জন্য তিনিও স্বর্গ ছেড়ে চলে গেলেন ।

লাঞ্ছিত ও পরাজিত দেবগণ প্রজাপ্রতি ব্রহ্মাকে নিয়ে হরি আর হর এর কাছে গেলেন । সেখানে মহিষাসুরের ও তার দানব সেনার অত্যাচারের কথা জানালে ত্রিদেব ভীষন ক্রোধ করলেন । ক্রোধে ত্রিদেবের বদন থেকে জ্যোতি বের হতে লাগলো । অনান্য সকল দেবতাদের শরীর থেকে জ্যোতি বের হয়ে তা পাহার প্রমান জ্যোতি হয়ে মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে প্রবেশ করল । সেখানে সেই জ্যোতি এর দিব্য নারী রুপ ধারন করল । মহাদেবের তেজে তার মুখ , ব্রহ্মার তেজে তাঁর পদ যুগল , শ্রী হরির তেজে তাঁর বাহু সমূহ , যমের তেজে কেশ রাশি , চন্দ্রের তেজে স্তন্য যুগল , ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্য ভাগ , বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু দ্বয় , পৃথিবীর তেজে তার নিতম্ব , সূর্যের তেজে চরণের আঙ্গুল , অষ্টবসুর তেজে হাতের আঙ্গুল , কুবেরের তেজে নাসিকা , দক্ষ ও অনান্য প্রজাপতি গনের তেজে দাঁত , অগ্নির তেজে তার ৩ টি চোখ , প্রাতঃ এবং সায়ং এই ২ সন্ধ্যা দেবীর তেজে ২ কর্ণ তৈরি হল । এই ভাবে বিশ্বকর্মা ও অনান্য দেবতাদের তেজে মহামায়ার আবির্ভাব হল ।

দেবী যুদ্ধে যাবেন । তাই তার অস্ত্র দরকার । প্রত্যেক দেবতা ও ত্রিদেব তাদের অস্ত্র থেকে অনুরূপ আরো একটি অস্ত্র তৈরি করে দেবীকে দিলেন । মহাদেব ত্রিশূল , বিষ্ণু চক্র , বরুণ দেব শঙ্খ , অগ্নিদেব শক্তি অস্ত্র , পবন ধনুক ও বাণে পূর্ণ ২ টি তূন , ইন্দ্র বজ্র , ঐরাবত ঘণ্টা , মৃত্যুদেব কালদন্ড , জলদেবতা পাশ , ব্রহ্মা রুদ্রাক্ষ মালা ও কমুন্ডল , সূর্য দেব উজ্জ্বল কিরণ এবং নিমেষ দেবতা কালাভিমানী দেবতা খড়গ ও ঢাল , ক্ষীর সাগর বস্ত্র – দিব্য চূড়া – ২ টি কুণ্ডল – সকল হাতের বলয় – শুভ্র ললাট ভূষন – সকল বাহুতে কেয়ূর – নূপুর – কণ্ঠের ভূষণ – অঙ্গুরি , বিশ্বকর্মা অভেদ বর্ম , সমুদ্র দেবতা পদ্মের মালা ও হাতে পদ্ম , কুবের সুরা পূর্ণ পানপাত্র , নাগরাজ বাসুকী নাগ হার দিলেন । গিরিরাজ হিমালয় দিলেন একটি বলশালী সিংহ । অনান্য দেবতারা নানা অস্ত্র দিলেন ।

দেবী সিংহ পীঠে আরোহণ করে অট্টহাস ও গর্জন করতে লাগলেন । দেবীর গর্জনে সপ্তলোক কম্পিত হতে লাগলো । সিংহ এর গর্জনে চতুর্দিক ছেয়ে গেলো । দেবী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিতা হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন ।
দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারের কথা জানালো । দেবী তাদের অভয় দিলেন ।

অপরদিকে মহিষাসুর গুপ্তচর এর মাধ্যমে খবর পেলো যে দেবতারা তাকে বধ করার জন্য এক নারীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে । একথা যেনে অসুরেরা হাস্য করতে লাগল । অসুরেরা দেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ।

মেধস মুনি এভাবে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য কে দেবীর লীলা শোনালেন । রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য দেবীর পূজা করতে মনস্থির করলে মেধস মুনি তাদের দেবীর রূপ সম্পর্কে বললেন । তিনি মহালক্ষী , মহাসরস্বতী ও মহাকালীর রূপ সম্পর্কে বললেন । 

রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য নদীতীরে গিয়ে দুর্গাদেবীর মাটির মূর্তি তৈরি করে পুস্প , ধূপ – দীপ , হোম , নৈবেদ্যাদি দিয়ে পূজো করতে লাগলেন । কথিত আছে তাঁরা নিজের দেহের রক্ত দিয়ে দেবীকে পূ

জো করেছিলেন । তার পর তারা তিন বছর দেবীর তপস্যা করেন । দেবী খুশী হয়ে তাঁদের দর্শন দিলেন । তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূরন হওয়ার বর দিলেন । রাজা সুরথ এবার সৈন্য সামন্ত জুটিয়ে শত্রু রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন । দেবীর আশীর্বাদে রাজা সুরথ শত্রু দের ধ্বংস করে নিজের হারানো রাজ্য পুনঃ অধিকার করলেন । অপর দিকে সমাধি বৈশ্য মনে মনে ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তির ইচ্ছা করেছিলেন । দেবী চন্ডীকার আশীর্বাদে সমাধি বৈশ্য ব্রহ্মজ্ঞান পেলেন । রাজা সুরথ দেবীর কাছে বর পেয়েছিলেন যে – পরজন্মে সুরথ রাজা সূর্যদেবের ঔরসে তাঁর পত্নী সবর্নার গর্ভে জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে সাবর্ণি নামে অষ্টম মণু হবেন ।


ক্ষমা প্রার্থনা


চন্ডী পাঠের পর অবশ্যই আমাদের ক্ষমা প্রার্থনা পাঠ করতে হয় । এতে দেবী প্রসন্না হন ।

“ হে দেবী মহেশ্বরী । এই শ্রী শ্রী চন্ডীপাঠ করার সময় ( মন্ত্রে ) আমার যে সকল অক্ষর পরিভ্রষ্ট ও মাত্রাহীন হয়েছে , তোমার কৃপায় সে সকল সম্পূর্ণ হোক ।

হে জগদম্বিকে , এই পাঠে আমি যে বিসর্গ , চন্দ্রবিন্দু বা অক্ষরবিহীন ( মন্ত্রে ) উচ্চারন করেছি , তা তোমার কৃপায় সম্পূর্ণ হোক এবং যেন আমার সঙ্কল্প সদাই সিদ্ধ হয় ।

হে জগদম্বে , সদ্যই তোমার এই স্তব পাঠ করার সময় ভক্তিতে বা অভক্তিতে , তাড়াতাড়ি পরার ফলে , স্পষ্ট বা অস্পষ্ট উচ্চারিত হওয়ায় এবং অনুস্বার , বিসর্গ , পদ , সমাস , বা বর্নাদির যে বিচ্যুতি ঘটেছে – যা মোহরূপে বা অজ্ঞানতার কারণে পাঠ করা হয়েছে বা পাঠ করা হয়নি , হে বরদায়িনী দেবী ভগবতী , তোমার প্রসাদে সে সকলই পূর্ণ হোক । হে দেবী , তুমি আমার প্রতি প্রসন্না হও ।

হে জননী ভগবতী , তুমি আমার প্রতি প্রসন্না হও । হে ভক্তবৎসলে , আমার প্রতি প্রসন্না হও । হে দেবী আমাকে কৃপা কর । হে দেবী দুর্গে , তোমাকে ভক্তিভরে প্রনাম করি ।

হে শঙ্করপ্রিয়ে , তোমার এই মাহাত্ম্য – যার জন্য পাঠ করা হল , তার বাড়ীর ও শরীরের সর্বদা কল্যাণ বা শান্তি হোক ।”

গদ্যে শ্রী শ্রী চন্ডীর মূল Post গুলি করেছেন সুমন বসাক 


Facebook Comment

আজকের তারিখ