কালী
কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীত্তিরত ।
মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা ।
কাল নির্মম সত্য , কিন্তু তাই বলে চূড়ান্ত সত্য নয় । কালেরও নিয়ন্ত্রী শক্তি আছে । কালশক্তির প্রভাবেই জগতের উৎপত্তি ও স্থিতি । মহাপ্রলয়ে সেই মহাকালই আবার সমগ্র সৃষ্টিকে গ্রাস করছেন । কিন্তু মনে রাখতে হবে , এমন যে মহাকাল , সেও পরিণামের অধীন । মহাপ্রলয়ে কালশক্তি মহাকালীর ভিতরেই নিঃশেষে লীন হয়ে যায় ।
রামপ্রসাদের ভাষায়
“ কালের কাল মহাকাল
সে কাল মায়ের পদানত ।”
কালী তন্ত্রের উক্তি
“ কালনিয়ন্ত্রাৎ কালী তত্ত্বজ্ঞানপ্রদায়িনী ।”
আদ্যাশক্তি
মহানির্বাণ তন্ত্র বলেছেন কালী আদ্যাশক্তি । কারন কালী নিখিল বিশ্বের আদি বীজ । কালের উৎপত্তি যখন হয় নি , তখন ছিলেন মহাকালী ।
“ তম আসীত্তমসা গুঢ়মগ্রে ” ( ঋক ১০/১২৯/৩)
“ তমো বা ইদমেকমগ্র আসীৎ ” ( মৈত্রায়নী শ্রুতি )
এই যে অনাদি অনন্ত শুদ্ধ তমস্ – তন্ত্র শাস্ত্র এঁকেই আখ্যা দিয়েছেন আদ্যাশক্তি কালী রূপে । কালীর এ কালো রুপ বৈভবের মহিমা বাক্য মনের অগোচর ।
মহানির্বাণ তন্ত্র বলেন
“ সৃষ্টৈরাদৌ ত্বমেকাসীত্তোমারুপগোচরম্ ”
হে দেবী , সৃষ্টির আদিতে তমো রুপে তুমিই মাত্র ছিলে , তোমার সে তমোময় রুপ বাক্য ও মনের অগোচর ।
মা কালী মহাশক্তি । যা ছিল , যা আছে এবং যা থাকবে সব মা কালীর মধ্যেই আছে । অনন্ত , আদি , বর্তমান সব কালী মায়ের মধ্যেই আছে ।
ধ্বংসের দেবী
ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে আছে । যেমন ঘন কালো রাত্রির পর দিন আসে । তেমনি ধ্বংসের পর সৃষ্টি হয় । ঘন কালো মেঘ বিদায় হলেই আকাশে ঝলমলে সূর্য ওঠে । তাই ধ্বংস ছাড়া সৃষ্টির বিকাশ সম্ভব নয় ।
মা কালী হলেন আদ্যাশক্তি । জগতের মূল শক্তি ইনি । ইনি মহা সরস্বতী । ইনিই মহা লক্ষ্মী । ইনি রুদ্রানী শিবানী । ইনি ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী , নারায়নের শক্তি নারায়নী , শিবের শক্তি শিবা । ইনি নারসিংহী , ইনি বারাহী , ইনি কৌমারী , গন্ধেশ্বরী । ইনি শ্রী রামচন্দ্রের শক্তি সীতা দেবী ( বামস্য জানকী ত্বং হি রাবনধ্বংসকারিনী ) , ইনি শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি , ইনি শ্রী রামকৃষ্ণের সহধর্মিণী মা সারদা । ইনি মহিষমর্দিনী চণ্ডী , ইনি চামুন্ডা , কৌষিকী , দুর্গা ভগবতী । এই ব্রহ্মাণ্ড তাঁর ইচ্ছাতেই চলছে । মায়ের ইচ্ছা ভিন্ন গাছের একটা পাতাও নড়ে না ।
সংহার রুপিনী
সংহার শব্দের অর্থ ঠিক ধবংস নয় । সংহরন । নিজের ভিতরে প্রত্যাকর্ষণ । যেমন সমুদ্রের ঊর্মিমালা সমুদ্রের বক্ষ থেকেই উদ্ভুত হয় আবার সমুদ্রেই লয় হয় । যেম্ন উর্ণণাভ নিজের গর্ভ থেকে জাল রচনা করে আবার নিজের পেটেই গুটিয়ে নেয় । মৃত্যুর অর্থ পৃথিবী থেকে , নিকট জনের থেকে চির বিদায় নেওয়া – কিন্তু সেই জগত জননীর কোলে আশ্রয় পাওয়া ।
এই ব্রহ্মাণ্ড সেই মহামায়ার ইচ্ছাতেই রচিত , সংহার কালে তিনি আবার সব গুটিয়ে নেন ।
শিবের ওপর কালী
মহাদেব এখানে শব রূপ । এর মৃত্যুরুপ শিবের বুকে স্বয়ং জগত মাতা । এর মানে হল মৃত্যু কে জয় ।
দেবী কালী দিগম্বরী । এর অর্থ তিনি কোন কিছুর বন্ধনে আবদ্ধ নন । তিনি দেশ কালের ওপরে । তিনি সকল জীবের মাতা ।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন কিছু পণ্ডিত বসনকে কামনা বাসনার প্রতীক বলেছেন । ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গোপীনি দের বস্ত্র হরণ করেছিলেন । যারা মূর্খ , নাস্তিক তারা এর মধ্যে অশ্লীলতার প্রসঙ্গ খোঁজেন । এর মানে কিন্তু এই না আমাদের বসনহীন হয়ে থাকতে হবে । খালি কামনা বাসনা আদি ষড়রিপু বর্জন করতে হবে । তবেই দেবকৃপা পাওয়া যাবে । তাই সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে অহং ও অবিদ্যা কে ত্যাগ করেই মায়ের কাছে যেতে হবে ।
মা মুক্ত স্বভাবা । তাই তিনি মুক্তকেশী । তাঁর জ্ঞান খড়গের দ্বারা অষ্টপাশ ছিন্ন হলেই নিস্কাম সাধক দেবীর কৃপা পান । তবেই মুক্তি ঘটে
রামপ্রসাদ তাই গাইলেন
“ মুক্ত কর মা মুক্তকেশী
ভবে যন্ত্রনা পাই দিবানিশি । ”
দেবী কালীর সেই কেশ মৃত্যুর প্রতীক । চন্ডীতে আছে মহিষাসুরের হাতে পরাজিত দেবতারা যখন ত্রিদেবের কাছে গেলেন তখন ত্রিদেব ও সমস্ত দেবতাদের তেজ রাশি একত্রিত হয়ে ভগবতী মহামায়ার আবির্ভাব ঘটে । যমের তেজে দেবীর কেশরাশি গঠিত হয় ।
মায়ের কন্ঠে মুণ্ডমালা । কন্ঠমালা পঞ্চাশৎ । যা সংস্কৃত পঞ্চাশৎ বর্ণমালার প্রতীক । শব্দই হল ব্রহ্ম । কামধেনু তন্ত্রে দেবী স্বয়ং বলেছেন
“ মম কণ্ঠে স্থিতং বীজং পঞ্চাশদ্ বর্ণমদ্ভুতম্ । ”
রামপ্রসাদ তাই গেয়েছেন
যত শোন কর্ণপুটে সকল মায়ের মন্ত্র বটে ।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে ।
মুন্ডমালা হল জ্ঞান শক্তির প্রতীক । দেবী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন । তিনি চেতনা দান করেন । অন্ধকারে আবদ্ধ জীবকে আলোর পথ দেখান ।
দেবী কালী কটি দেশে নর হস্তের মেখলা । কিন্তু কেন ? হস্ত কর্মশক্তির প্রতীক ।
দেবী কালীর ত্রিনয়ন । দেবীর একটি নয়ন চন্দ্র স্বরূপ , আর একটি সূর্য স্বরূপ । তৃতীয়টি অগ্নি স্বরূপ । দেবী ভূত , ভবিষ্যৎ , বর্তমান সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন । তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই ত্রিকাল নিয়ন্ত্রিত হয় । প্রকাশ্য দিবালোকে , সন্ধ্যায় বা রাত্রে আমরা যে কাজ করি নে কেন তিনি দেখছেন ।
আমরা যদি গোপনে পাপ কাজ করে প্রভাব খাটিয়ে এই পৃথিবীর বিচারসভার হাত থেকে নিস্কৃতি পাইও , তবুও দেবী সব দেখেন – তাঁর বিচার থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যাবে না ।
দেবীর চার হাত । তাঁর ওপরের দুহাতে অভয় ও খড়গ । নীচে বর মুদ্রা ও ছিন্ন নরমুণ্ড । অভয় ও বরামুদ্রা সৃষ্টির প্রতীক । খড়গ ও ছিন্ন নরমুণ্ড ধ্বংসের প্রতীক । দুটি বিপরীত কাজ হলেও আমরা মা কালীর মধ্যে দুটিকেই দেখতে পাই । এর অর্থ দেবী কালীর ইচ্ছাতেই সৃষ্টি হয় , তার ইচ্ছাতেই ধ্বংস হয় । দেবী তার খড়গ দ্বারা অবিদ্যা রুপী অসুরকে ধ্বংস করেন ।
দেবী কালী উলঙ্গিনী । তাই কিছু নাস্তিক , মূর্খ ও বুদ্ধিজীবি শ্রেনীর মানুষ অনেক সময় খারাপ কিছুর সঙ্গে উলঙ্গিনী মায়ের তুলনা করে বসেন । মা উলঙ্গিনী বটে – কিন্তু তিনি যে তাঁর বাৎসল্যের স্নেহধারা তাঁর সকল সন্তান দের জন্যই রেখেছেন । তিনিই ত অন্নপূর্ণা রুপে ধান , শস্যে ভরিয়ে দিয়েছেন । তিনি শাকম্ভরী , তিনিই শতাক্ষী । মা হল পরম করুণাময়ী । সন্তানের দুঃখে তিনি কাঁদেন , সন্তানের উল্লাসেই তিনি আনন্দিত হন ।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন । অনেক পণ্ডিতরা বলেন মা শীতলা নাকি সকলকে বসন্ত রোগের জীবানু দেন । এমন কোন মা আছে যে তার সন্তান দের তিনি রোগ দেবেন ? তাঁর সন্তান রা রোগে কষ্ট পাবে আর তিনি দেখবেন । এমন ধারনা ‘মা’ শব্দের অপমান ।
দেবীর রক্তমাখা জিহ্বা রজঃ গুনের প্রতীক । তিনি তার শ্বেত দন্ত পাটি দ্বারা জিহ্বা কেটেছেন । শ্বেত বর্ণ হল স্বত্বঃ গুনের প্রতীক । এর মানে মা আমাদের স্বত্বঃ গুন দ্বারা রজঃ গুনকে সংহত করার শিক্ষে দিচ্ছেন ।
দেবী মহাশ্মশ্মান এ বিচরণ করেন । কর্মফল ভোগান্তে জীবের শেষ আশ্রয় স্থল হল শ্মশ্মান । যেখানে তারা জননীর কোলে সুখে নিদ্রা যায় । মায়ের আঁচল এর তুলনা কোটী কোটি স্বর্গের সাথেও হয় না । যেখানে বাৎসল্যের ছোঁয়া লেগেই থাকে । “ মায়ের কোলে ঘুমায় ছেলে , এ শান্তি মা কোথায় বল ?”
মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম ।।
আদ্যাশক্তি শ্রী শ্রী কালী বিশ্ব প্রসবিনী । পরম পুরুষ মহাকাল শিবের সাথে মিথুন ক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন । এই রতি ক্রিয়া পরমার্থিক ।
মায়ের অনন্ত কোটি রুপ । তন্ত্রে ৯ রকম কালী মূর্তির কথা আছে । সংক্ষিপ্ত আকারে তা দেওয়া হল ।
“ করালবদনাং ঘোরাং ” ধ্যান মন্ত্র টি দক্ষিণা কালীর ধ্যান । তিনি করালবদনা , ঘোরা , মুক্তকেশী , চতুর্ভুজা , দিব্যা এবং মুন্ডমালা বিভূষিতা । তিনি মহা মেঘ প্রভা শ্যামা ও দিগম্বরী । তাঁর গলদেশের মুন্ডমালা থেকে রুধিরধারা বিগলিত হয়ে সর্বাঙ্গ অনুলিপ্ত করছে । তার কর্ণে শবদ্বয় ভূষণ রুপে বিদ্যমান , এবং তাতে তিনি হয়েছেন আরো ভয়ানক । তিনি ঘোর দ্রংষ্ট্রা , করান্যাসা , পীনোন্নতপয়োধরা , শব সমূহের কর দ্বারা দেবীর কাঞ্চী রচিত এবং তিনি হাস্যমুখী । দেবী ঘোররাবা , মহারৌদ্রী ও শ্মশ্মান বাসিনী । তাঁর ত্রিনয়ন নবোদিত সূর্য মণ্ডল স্বরূপ । দেবী সুবিন্যস্ত ও সুপরিপাটী দন্ত বিশিষ্টা , তাঁর আলুলায়িত কেশরাশি দক্ষিণ ভাগে লম্বমান । তিনি শবরুপী মহাদেবের হৃদয়োপরি অবস্থিতা । দেবীর চতুর্দিকে চিৎকার পরায়ণ শিবা গণ অবস্থান করেন এবং দেবী মহাকালের সাথে বিপরীত ক্রিয়াতে রতা । দেবীর বদন সুখপ্রসন্ন , তাঁর শ্রী মুখপদ্ম মৃদুমন্দ হাস্যে সমুজ্জ্বল ।
আমরা সকলে দক্ষিণা কালীর ই পূজো করে থাকি ।
ইনি অঞ্জনাদ্রিনিভা , রক্তনেত্রা , মুক্তকেশী , শুস্কমাংসা , অতি ভৈরবা , পিঙ্গল নয়না । এঁনার বাম হস্তে মাংস ও মদ থাকে দক্ষিণ হস্তে সদ্যশ্ছিন্ন নরমুণ্ড থাকে । ইনি স্মিতবক্ত্রা , সর্বদা আমমাংস চর্বণ তৎপরা , নগ্না , সদা মদ্যপানে প্রমত্তা । ইনি নানা অলঙ্কার পড়েন ।
এঁনার পূজা গৃহস্থ বাড়িতে হয় না । শ্মশ্মানেই এই মায়ের পূজো হয় ।
ইনি মহামেঘপ্রভা , কৃষ্ণ বস্ত্র পরিধান করেন , লোলজিহ্বা , ঘোর দ্রংষ্ট্রা , কোটাক্ষী , হসন্মুখী , এঁনার কন্ঠে নাগ হার । , ভালে অর্ধচন্দ্র , শিরের জটাজাল নভো স্পর্শী । ইনি শব আস্বাদনে আসক্তা । গুহ্যকালী নাগ যজ্ঞপবীত ধারন করেন , নাগশয্যেপরি বিরাজিতা । এঁনার কন্ঠদেশে পঞ্চাশৎ মুন্ড সংযুক্ত বনমালা , ইনি মহোদরী । সহস্র ফনা যুক্ত অনন্ত নাগ এঁর শিরোপরি এঁনার চতুর্দিকে নাগ গণ ফণা তুলে বেষ্টন করে থাকেন । সর্পরাজ তক্ষক দেবীর বাম হস্তের কঙ্কণ এবং অনন্ত নাগ দক্ষিণ হস্তের কঙ্কণ । ইনি নাগ নির্মিত কাঞ্চী ও রত্ন নূপুর ধারন করেন । এঁর বাম দিকে শিব সব্রুপ কল্পিত বৎস্য থাকে । ইনি দ্বিভুজা , এনার শ্রুতি দ্বয় নরদেহসমাবদ্ধ কুন্ডল দ্বারা শোভিত থাকে । ইনি প্রসন্ন বদনা , সৌম্যা , নারদাদি মুনি গণ সেবিতা । কিন্তু পুনশ্চ অট্টহাস্য কারিনী , মহাভীমা , সাধকের অভিষ্ট দায়িনী ।
গুহ্যকালীর পূজো গৃহস্থ বাড়িতে হয় না । তিনি কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা । তবে কিছু পণ্ডিত এর মতে গ্রহ দোষ কাটানোর জন্য গৃহস্থ বাড়ীতে এই মায়ের পূজো করা যেতে পারে ।
সিদ্ধকালী তার দক্ষিণের হস্তের খড়গ দ্বারা চন্দ্র মণ্ডল উদ্ভিন্ন করছেন । সেই চন্দ্র মণ্ডলের গলিত রস দেবীর সর্বাঙ্গ প্লাবিত করছে । তিনি বাম হস্তের কপাল পাত্রে ঐ অমৃত ধারন করে পান করছেন । দেবী ত্রিনয়নী , মুক্তকেশী , দিগম্বরা । তাঁর কটিদেশ কাঞ্চী দ্বারা বদ্ধ । শিরে মনি মুক্ত খচিত মুকুট । তিনি দীপ্তজীহবা , এঁনার তনু কান্তি নীলোৎপল সদৃশ । কর্ণে তার রবি শশী তুল্য সমুজ্জ্বল কুন্ডল দ্বয় , দেবী আলীঢ়পাদা ।
সিদ্ধকালী মাতা কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা । গৃহস্থ ব্যাক্তিরা এঁনার পূজো করেন না ।
ইনি মেঘাঙ্গী , শশী শেখরা , ত্রিনয়না , রক্তাম্বরা , বরভয়করা , রক্তারবিন্দস্থিতা , মাধ্বীক পুস্পজাত মধুর মদ্য পান পূর্বক তাঁর সম্মুখে নৃত্যপর মহাকালকে দর্শন করে দেবী বিকাসিতাননা ।
আদ্যাকালীর পূজো গৃহস্থ ও সাধক সবাই করতে পারেন ।
তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে মহাকালী পঞ্চদশ নয়না , মহারৌদ্রী । এঁনার হাতে শক্তি , শূল , ধনু , বাণ , খড়গ , খেটক , বর ও অভয় থাকে । শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থানুসারে পুরাকালে ভগবান বিষ্ণুর কর্ণ থেকে মধু আর কৈটভ নামক দুই অসুর জন্মান । তারা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে আক্রমণ করলে , ব্রহ্মদেব প্রান রক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন । কিন্তু যোগমায়ার প্রভাবে ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন । ব্রহ্মদেব তখন ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগানোর জন্য আদিশক্তির স্তব করলেন , ব্রহ্মার স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগিয়ে প্রকট হলেন । ও মহাকালী রুপে প্রকট হলেন ।
দেবী মহাকালী দশবক্ত্রা , দশভুজা , দশপাদা , ত্রিংশ লোচনা , । দ্রংষ্ট্রা উজ্জ্বল । ইনি ভয়ঙ্করী । ইনি রুপ , সৌভাগ্য , কান্তি , মহতী , শ্রীর অধিষ্ঠাত্রী । ইনি তার ১০ হাতে খড়গ , বাণ , গদা , শূল , শঙ্খ , চক্র , ভূশণ্ডি , পরিঘ , ধনু , রুধিরাক্ত নরমুণ্ড ধারিনী ।
কেবল সাধক রাই এঁনার পূজো করতে পারেন । কথিত আছে ইনি প্রথমে সাধককে নানা ভাবে ভয় দেখান । সাধক ভয় তুচ্ছ করে সাধনার পরীক্ষায় সফল হলে ইনি নানা রকম সিদ্ধি দান করেন ।
শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থানুসারে চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব দেবী কৌষিকীর সাথে যুদ্ধ করতে আসলে দেবী তার ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করেন । সেখানে থেকেই দেবী চামুন্ডার আবির্ভাব হয় । চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব কে বধ করার জন্য তিনি চামুন্ডা নামে খ্যাত হন । তিনি বিচিত্র নর কঙ্কাল ধারিনী , নরমুণ্ড মালিনী , ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা , অস্থি চর্মসার দেহ স্বরূপা । অতি ভীষনা , বিশাল বদনা , লোলজিহ্বা , ভয়ঙ্করী , কোটর গতা , আরক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং সিংহ নাদে দিক মণ্ডল পূর্ণ কারিনী ।
চামুন্ডাকালী মাতা শব বাহনা । ইনি চতুর্ভুজা ।
এঁনার পূজো কেবল সাধক দের জন্যই । গৃহস্থ বাড়ীতে বা গৃহস্থ লোকেরা এনার পূজো করেন না ।
তন্ত্র মতে ভদ্রকালী ক্ষুধায় ক্ষীণা । কোটোরাক্ষী , মসিমলিনমুখী , মুক্তকেশী । ভদ্রকালীর কর দ্বয়ে জ্বলন্ত অনল শিখার ন্যায় দীপ্ত পাশ যুগ্ম থাকে । দেবী পুরাণ বলেন – দেবী অন্তিমে মৃত্যুকালে ভদ্র বা মঙ্গল বিধান করেন , তাই তিনি ভদ্রকালী । কালিকা পুরাণ মতে দেবীর গাত্রবর্ণ অতসী পুস্পের ন্যায় , এবং কর্ণে উজ্জ্বল কুন্ডল থাকে । তাঁর মস্তক জটাজুট , অর্ধচন্দ্র , মুকুটে ভূষিত , নাগ হার ও স্বর্ণ হার তাঁর ভূষন । তাঁর দক্ষিণ বাহুতে শূল , চক্র , খড়গ , শঙ্খ , বাণ , শক্তি , বজ্র , দন্ড এবং বাম করে খেটক , চর্ম্ম , চাপ , পাশ , অঙ্কুশ , ঘণ্টা , পরশু , মূষল থাকে । ইনি সিংহ বাহনা , তাঁর আরক্ত ত্রিনয়ন অতিশয় দীপ্ত । ইনি বামপদ দ্বারা মহিষাসুরকে আক্রমণ পূর্বক শূল দ্বারা তাকে বিদীর্ণ করে অবস্থিতা । বস্তুত ইনি দুর্গামূর্তি ।
এঁনার পূজো গৃহস্থ ও সাধক উভয়েই করতে পারেন ।
ইনি চতুর্ভুজা , কৃষ্ণবর্ণা , মুন্ডমালা বিভূষিতা । দক্ষিণ কর দ্বয়ে খড়গ , নীলপদ্ম থাকে । বাম কর দ্বয়ে অসি ও খর্পর থাকে । এঁনার গগনস্পর্শী জটিল শীর্ষে এবং কন্ঠে মুন্ডমালা । ইনি রক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং বক্ষে নাগ হার যুক্তা । এঁনার পরিধানে কৃষ্ণ বস্ত্র , কটিতে ব্যাঘ্রচর্ম । ইনি বাম পদ শব হৃদয় এ এবং দক্ষিণ পদ সিংহ পৃষ্ঠে স্থাপন পূর্বক মদ্যপানে নিরতা । ইনি অট্টহাস্যা , মহাঘোররাবযূতা এবং সু ভীষণা ।
দারুকাসুর মর্দিনী কালী মাতা
লিঙ্গ পুরান এ এই কালী মায়ের কথা বলা আছে । ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ পূর্বক মহাদবের কন্ঠে স্থিত গরলে নিজ তনু কৃষ্ণ বর্ণ করেছেন । মহাদেবের ন্যায় ইনি ত্রিশূল ধারিনী , শ্রীকরে সর্প বলয় যুক্তা । লিঙ্গ পুরান মতে ইনি দারুক নামক এক অসুরকে বধ করেছিলেন । এনাকে শ্রী কালী ও বলা হয় ।
অন্তিমে সকলে আমরা সেই আদ্যাশক্তি মা কালীকে বন্দনা করি । তিনি আমাদের সকলের মধ্যে শক্তিরুপে জেগে উঠুন । তাঁর শক্তিতেই যেন আমরা বলবান হই । কোন ক্লীবতা যেনো আমদের স্পর্শ করতে না পারে । অন্তিমে যেনো সেই জগত জননীর কোলে ফিরে যেতে পারি ।
জাগো , জাগো, জাগো জননী ,
তুমি না জাগিলে শ্যামা
আর তো কেউ জাগে না মা ,
তুমি না নাচিলে মাগো
নাচিবে না ধমনী ।
শ্রী শ্রী কালী মা সাক্ষাৎ ব্রহ্মময়ী । তিনি আমাদের অবিদ্যা রুপিনী অন্ধকার কে নাশ করে আমাদের জ্ঞান দেন , চেতনা দেন । তাঁর ত্রিনয়ন চন্দ্র , সূর্য , অগ্নি । তার লোমকূপ সকল কোটি কোটি প্রতীপ্ত তারকা । তার আবির্ভাবে অন্ধকার ময় অবিদ্যা , আসুরিক শক্তি নাশ হয়ে যায় । তাই কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় আমরা শত শত প্রদীপের আলোকমালায় সেই জগত মাতাকে বরন করে নেই । প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আমাদের অন্ধকার অবিদ্যার জাল থেকে মুক্ত করে দেন ।
জগতজননী মা ও ভারতমাতা অভিন্না । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ‘আনন্দমঠ’ তিনি ভারতমাতা ও মহিষমর্দিনী দুর্গাকে এক বলে বর্ণনা করেছেন ।
“ বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি গড়ি মন্দিরে মন্দিরে ।
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরনধারিনী
কমলা কমল – দলবিহারিণী ”
“ – “ এই যে মা হইবেন । দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত ,- তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত , পদতলে শত্রু বিমর্দিত , পদাশ্রিত , বীরকেশরী , শত্রু নিপীড়নে নিযুক্ত । দিগভুজা ” (আনন্দমঠ / একাদশ পরিচ্ছেদ )
পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয় বিপ্লবীরা ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যখন প্রস্তুত হতেন – প্রথমেই নিতে হত জগত জননী কালী মায়ের আশীর্বাদ । কথিত আছে বিপ্লবী রা কালীঘাট বা তারাপীঠ গিয়ে দেবীর চরণ ছুয়ে দেশমাতৃকার উদ্ধার এর জন্য কঠোর সংকল্প নিতেন ।
ফাঁসীর আগে যখন ক্ষুদিরাম কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল “ অন্তিম ইচ্ছা কি? ”ক্ষুদিরাম জানিয়েছিলেন , তিনি দেবী চতুর্ভুজার প্রসাদ খেতে চান । ( আঠেরোর দীপ্তশিখা ক্ষুদিরাম/ লেখক- সুশান্তকুমার সাহিত্যরত্ন)
হে দেবী , সৃষ্টির আদিতে তমো রুপে তুমিই মাত্র ছিলে , তোমার সে তমোময় রুপ বাক্য ও মনের অগোচর ।
মা কালী মহাশক্তি । যা ছিল , যা আছে এবং যা থাকবে সব মা কালীর মধ্যেই আছে । অনন্ত , আদি , বর্তমান সব কালী মায়ের মধ্যেই আছে ।
ধ্বংসের দেবী
ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে আছে । যেমন ঘন কালো রাত্রির পর দিন আসে । তেমনি ধ্বংসের পর সৃষ্টি হয় । ঘন কালো মেঘ বিদায় হলেই আকাশে ঝলমলে সূর্য ওঠে । তাই ধ্বংস ছাড়া সৃষ্টির বিকাশ সম্ভব নয় ।
মা কালী হলেন আদ্যাশক্তি । জগতের মূল শক্তি ইনি । ইনি মহা সরস্বতী । ইনিই মহা লক্ষ্মী । ইনি রুদ্রানী শিবানী । ইনি ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী , নারায়নের শক্তি নারায়নী , শিবের শক্তি শিবা । ইনি নারসিংহী , ইনি বারাহী , ইনি কৌমারী , গন্ধেশ্বরী । ইনি শ্রী রামচন্দ্রের শক্তি সীতা দেবী ( বামস্য জানকী ত্বং হি রাবনধ্বংসকারিনী ) , ইনি শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি , ইনি শ্রী রামকৃষ্ণের সহধর্মিণী মা সারদা । ইনি মহিষমর্দিনী চণ্ডী , ইনি চামুন্ডা , কৌষিকী , দুর্গা ভগবতী । এই ব্রহ্মাণ্ড তাঁর ইচ্ছাতেই চলছে । মায়ের ইচ্ছা ভিন্ন গাছের একটা পাতাও নড়ে না ।
সংহার রুপিনী
সংহার শব্দের অর্থ ঠিক ধবংস নয় । সংহরন । নিজের ভিতরে প্রত্যাকর্ষণ । যেমন সমুদ্রের ঊর্মিমালা সমুদ্রের বক্ষ থেকেই উদ্ভুত হয় আবার সমুদ্রেই লয় হয় । যেম্ন উর্ণণাভ নিজের গর্ভ থেকে জাল রচনা করে আবার নিজের পেটেই গুটিয়ে নেয় । মৃত্যুর অর্থ পৃথিবী থেকে , নিকট জনের থেকে চির বিদায় নেওয়া – কিন্তু সেই জগত জননীর কোলে আশ্রয় পাওয়া ।
এই ব্রহ্মাণ্ড সেই মহামায়ার ইচ্ছাতেই রচিত , সংহার কালে তিনি আবার সব গুটিয়ে নেন ।
শিবের ওপর কালী
মহাদেব এখানে শব রূপ । এর মৃত্যুরুপ শিবের বুকে স্বয়ং জগত মাতা । এর মানে হল মৃত্যু কে জয় ।
দিগম্বরী
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন কিছু পণ্ডিত বসনকে কামনা বাসনার প্রতীক বলেছেন । ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গোপীনি দের বস্ত্র হরণ করেছিলেন । যারা মূর্খ , নাস্তিক তারা এর মধ্যে অশ্লীলতার প্রসঙ্গ খোঁজেন । এর মানে কিন্তু এই না আমাদের বসনহীন হয়ে থাকতে হবে । খালি কামনা বাসনা আদি ষড়রিপু বর্জন করতে হবে । তবেই দেবকৃপা পাওয়া যাবে । তাই সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে অহং ও অবিদ্যা কে ত্যাগ করেই মায়ের কাছে যেতে হবে ।
মুক্তকেশী
মা মুক্ত স্বভাবা । তাই তিনি মুক্তকেশী । তাঁর জ্ঞান খড়গের দ্বারা অষ্টপাশ ছিন্ন হলেই নিস্কাম সাধক দেবীর কৃপা পান । তবেই মুক্তি ঘটে
রামপ্রসাদ তাই গাইলেন
“ মুক্ত কর মা মুক্তকেশী
ভবে যন্ত্রনা পাই দিবানিশি । ”
দেবী কালীর সেই কেশ মৃত্যুর প্রতীক । চন্ডীতে আছে মহিষাসুরের হাতে পরাজিত দেবতারা যখন ত্রিদেবের কাছে গেলেন তখন ত্রিদেব ও সমস্ত দেবতাদের তেজ রাশি একত্রিত হয়ে ভগবতী মহামায়ার আবির্ভাব ঘটে । যমের তেজে দেবীর কেশরাশি গঠিত হয় ।
মুন্ডমালা
“ মম কণ্ঠে স্থিতং বীজং পঞ্চাশদ্ বর্ণমদ্ভুতম্ । ”
রামপ্রসাদ তাই গেয়েছেন
যত শোন কর্ণপুটে সকল মায়ের মন্ত্র বটে ।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে ।
মুন্ডমালা হল জ্ঞান শক্তির প্রতীক । দেবী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন । তিনি চেতনা দান করেন । অন্ধকারে আবদ্ধ জীবকে আলোর পথ দেখান ।
হস্তের মেখলা
দেবী কালী কটি দেশে নর হস্তের মেখলা । কিন্তু কেন ? হস্ত কর্মশক্তির প্রতীক ।
ত্রিনয়নী
দেবী কালীর ত্রিনয়ন । দেবীর একটি নয়ন চন্দ্র স্বরূপ , আর একটি সূর্য স্বরূপ । তৃতীয়টি অগ্নি স্বরূপ । দেবী ভূত , ভবিষ্যৎ , বর্তমান সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন । তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই ত্রিকাল নিয়ন্ত্রিত হয় । প্রকাশ্য দিবালোকে , সন্ধ্যায় বা রাত্রে আমরা যে কাজ করি নে কেন তিনি দেখছেন ।
আমরা যদি গোপনে পাপ কাজ করে প্রভাব খাটিয়ে এই পৃথিবীর বিচারসভার হাত থেকে নিস্কৃতি পাইও , তবুও দেবী সব দেখেন – তাঁর বিচার থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যাবে না ।
চারিহস্ত
কৃষ্ণবর্ণ
কালী মাতা কৃষ্ণবর্ণা । আদিতে যখন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কিছুই ছিল না তখনও তিনি ছিলেন । তিনি অনন্ত । তিনি আদিতেও ছিলেন , তাই তিনি কৃষ্ণবর্ণা ।
কখনো তিনি নীলবর্ণা । যা সুদীর্ঘ সুনীল নীল আকাশের তুলনীয় । এর অর্থ দেবী অনন্ত । অনন্ত তার লীলা প্রকাশ । যা ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বরের অগোচর ।
বিবসনা স্তন্য
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন । অনেক পণ্ডিতরা বলেন মা শীতলা নাকি সকলকে বসন্ত রোগের জীবানু দেন । এমন কোন মা আছে যে তার সন্তান দের তিনি রোগ দেবেন ? তাঁর সন্তান রা রোগে কষ্ট পাবে আর তিনি দেখবেন । এমন ধারনা ‘মা’ শব্দের অপমান ।
রক্তমাখা জিহ্বা
মহা শ্মশ্মান বাসিনী
বিপরীত রতাতুরা
আদ্যাশক্তি শ্রী শ্রী কালী বিশ্ব প্রসবিনী । পরম পুরুষ মহাকাল শিবের সাথে মিথুন ক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন । এই রতি ক্রিয়া পরমার্থিক ।
কালী মূর্তির প্রকারভেদ
মায়ের অনন্ত কোটি রুপ । তন্ত্রে ৯ রকম কালী মূর্তির কথা আছে । সংক্ষিপ্ত আকারে তা দেওয়া হল ।
দক্ষিণা কালী মাতা
“ করালবদনাং ঘোরাং ” ধ্যান মন্ত্র টি দক্ষিণা কালীর ধ্যান । তিনি করালবদনা , ঘোরা , মুক্তকেশী , চতুর্ভুজা , দিব্যা এবং মুন্ডমালা বিভূষিতা । তিনি মহা মেঘ প্রভা শ্যামা ও দিগম্বরী । তাঁর গলদেশের মুন্ডমালা থেকে রুধিরধারা বিগলিত হয়ে সর্বাঙ্গ অনুলিপ্ত করছে । তার কর্ণে শবদ্বয় ভূষণ রুপে বিদ্যমান , এবং তাতে তিনি হয়েছেন আরো ভয়ানক । তিনি ঘোর দ্রংষ্ট্রা , করান্যাসা , পীনোন্নতপয়োধরা , শব সমূহের কর দ্বারা দেবীর কাঞ্চী রচিত এবং তিনি হাস্যমুখী । দেবী ঘোররাবা , মহারৌদ্রী ও শ্মশ্মান বাসিনী । তাঁর ত্রিনয়ন নবোদিত সূর্য মণ্ডল স্বরূপ । দেবী সুবিন্যস্ত ও সুপরিপাটী দন্ত বিশিষ্টা , তাঁর আলুলায়িত কেশরাশি দক্ষিণ ভাগে লম্বমান । তিনি শবরুপী মহাদেবের হৃদয়োপরি অবস্থিতা । দেবীর চতুর্দিকে চিৎকার পরায়ণ শিবা গণ অবস্থান করেন এবং দেবী মহাকালের সাথে বিপরীত ক্রিয়াতে রতা । দেবীর বদন সুখপ্রসন্ন , তাঁর শ্রী মুখপদ্ম মৃদুমন্দ হাস্যে সমুজ্জ্বল ।
আমরা সকলে দক্ষিণা কালীর ই পূজো করে থাকি ।
শ্মশ্মান কালী মাতা
ইনি অঞ্জনাদ্রিনিভা , রক্তনেত্রা , মুক্তকেশী , শুস্কমাংসা , অতি ভৈরবা , পিঙ্গল নয়না । এঁনার বাম হস্তে মাংস ও মদ থাকে দক্ষিণ হস্তে সদ্যশ্ছিন্ন নরমুণ্ড থাকে । ইনি স্মিতবক্ত্রা , সর্বদা আমমাংস চর্বণ তৎপরা , নগ্না , সদা মদ্যপানে প্রমত্তা । ইনি নানা অলঙ্কার পড়েন ।
এঁনার পূজা গৃহস্থ বাড়িতে হয় না । শ্মশ্মানেই এই মায়ের পূজো হয় ।
গুহ্যকালী মাতা
ইনি মহামেঘপ্রভা , কৃষ্ণ বস্ত্র পরিধান করেন , লোলজিহ্বা , ঘোর দ্রংষ্ট্রা , কোটাক্ষী , হসন্মুখী , এঁনার কন্ঠে নাগ হার । , ভালে অর্ধচন্দ্র , শিরের জটাজাল নভো স্পর্শী । ইনি শব আস্বাদনে আসক্তা । গুহ্যকালী নাগ যজ্ঞপবীত ধারন করেন , নাগশয্যেপরি বিরাজিতা । এঁনার কন্ঠদেশে পঞ্চাশৎ মুন্ড সংযুক্ত বনমালা , ইনি মহোদরী । সহস্র ফনা যুক্ত অনন্ত নাগ এঁর শিরোপরি এঁনার চতুর্দিকে নাগ গণ ফণা তুলে বেষ্টন করে থাকেন । সর্পরাজ তক্ষক দেবীর বাম হস্তের কঙ্কণ এবং অনন্ত নাগ দক্ষিণ হস্তের কঙ্কণ । ইনি নাগ নির্মিত কাঞ্চী ও রত্ন নূপুর ধারন করেন । এঁর বাম দিকে শিব সব্রুপ কল্পিত বৎস্য থাকে । ইনি দ্বিভুজা , এনার শ্রুতি দ্বয় নরদেহসমাবদ্ধ কুন্ডল দ্বারা শোভিত থাকে । ইনি প্রসন্ন বদনা , সৌম্যা , নারদাদি মুনি গণ সেবিতা । কিন্তু পুনশ্চ অট্টহাস্য কারিনী , মহাভীমা , সাধকের অভিষ্ট দায়িনী ।
গুহ্যকালীর পূজো গৃহস্থ বাড়িতে হয় না । তিনি কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা । তবে কিছু পণ্ডিত এর মতে গ্রহ দোষ কাটানোর জন্য গৃহস্থ বাড়ীতে এই মায়ের পূজো করা যেতে পারে ।
সিদ্ধকালী মাতা
সিদ্ধকালী তার দক্ষিণের হস্তের খড়গ দ্বারা চন্দ্র মণ্ডল উদ্ভিন্ন করছেন । সেই চন্দ্র মণ্ডলের গলিত রস দেবীর সর্বাঙ্গ প্লাবিত করছে । তিনি বাম হস্তের কপাল পাত্রে ঐ অমৃত ধারন করে পান করছেন । দেবী ত্রিনয়নী , মুক্তকেশী , দিগম্বরা । তাঁর কটিদেশ কাঞ্চী দ্বারা বদ্ধ । শিরে মনি মুক্ত খচিত মুকুট । তিনি দীপ্তজীহবা , এঁনার তনু কান্তি নীলোৎপল সদৃশ । কর্ণে তার রবি শশী তুল্য সমুজ্জ্বল কুন্ডল দ্বয় , দেবী আলীঢ়পাদা ।
সিদ্ধকালী মাতা কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা । গৃহস্থ ব্যাক্তিরা এঁনার পূজো করেন না ।
আদ্যাকালী মাতা
ইনি মেঘাঙ্গী , শশী শেখরা , ত্রিনয়না , রক্তাম্বরা , বরভয়করা , রক্তারবিন্দস্থিতা , মাধ্বীক পুস্পজাত মধুর মদ্য পান পূর্বক তাঁর সম্মুখে নৃত্যপর মহাকালকে দর্শন করে দেবী বিকাসিতাননা ।
আদ্যাকালীর পূজো গৃহস্থ ও সাধক সবাই করতে পারেন ।
মহাকালী মাতা
তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে মহাকালী পঞ্চদশ নয়না , মহারৌদ্রী । এঁনার হাতে শক্তি , শূল , ধনু , বাণ , খড়গ , খেটক , বর ও অভয় থাকে । শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থানুসারে পুরাকালে ভগবান বিষ্ণুর কর্ণ থেকে মধু আর কৈটভ নামক দুই অসুর জন্মান । তারা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে আক্রমণ করলে , ব্রহ্মদেব প্রান রক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন । কিন্তু যোগমায়ার প্রভাবে ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন । ব্রহ্মদেব তখন ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগানোর জন্য আদিশক্তির স্তব করলেন , ব্রহ্মার স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগিয়ে প্রকট হলেন । ও মহাকালী রুপে প্রকট হলেন ।
দেবী মহাকালী দশবক্ত্রা , দশভুজা , দশপাদা , ত্রিংশ লোচনা , । দ্রংষ্ট্রা উজ্জ্বল । ইনি ভয়ঙ্করী । ইনি রুপ , সৌভাগ্য , কান্তি , মহতী , শ্রীর অধিষ্ঠাত্রী । ইনি তার ১০ হাতে খড়গ , বাণ , গদা , শূল , শঙ্খ , চক্র , ভূশণ্ডি , পরিঘ , ধনু , রুধিরাক্ত নরমুণ্ড ধারিনী ।
কেবল সাধক রাই এঁনার পূজো করতে পারেন । কথিত আছে ইনি প্রথমে সাধককে নানা ভাবে ভয় দেখান । সাধক ভয় তুচ্ছ করে সাধনার পরীক্ষায় সফল হলে ইনি নানা রকম সিদ্ধি দান করেন ।
চামুন্ডাকালী মাতা
চামুন্ডাকালী মাতা শব বাহনা । ইনি চতুর্ভুজা ।
এঁনার পূজো কেবল সাধক দের জন্যই । গৃহস্থ বাড়ীতে বা গৃহস্থ লোকেরা এনার পূজো করেন না ।
ভদ্রকালী মাতা
তন্ত্র মতে ভদ্রকালী ক্ষুধায় ক্ষীণা । কোটোরাক্ষী , মসিমলিনমুখী , মুক্তকেশী । ভদ্রকালীর কর দ্বয়ে জ্বলন্ত অনল শিখার ন্যায় দীপ্ত পাশ যুগ্ম থাকে । দেবী পুরাণ বলেন – দেবী অন্তিমে মৃত্যুকালে ভদ্র বা মঙ্গল বিধান করেন , তাই তিনি ভদ্রকালী । কালিকা পুরাণ মতে দেবীর গাত্রবর্ণ অতসী পুস্পের ন্যায় , এবং কর্ণে উজ্জ্বল কুন্ডল থাকে । তাঁর মস্তক জটাজুট , অর্ধচন্দ্র , মুকুটে ভূষিত , নাগ হার ও স্বর্ণ হার তাঁর ভূষন । তাঁর দক্ষিণ বাহুতে শূল , চক্র , খড়গ , শঙ্খ , বাণ , শক্তি , বজ্র , দন্ড এবং বাম করে খেটক , চর্ম্ম , চাপ , পাশ , অঙ্কুশ , ঘণ্টা , পরশু , মূষল থাকে । ইনি সিংহ বাহনা , তাঁর আরক্ত ত্রিনয়ন অতিশয় দীপ্ত । ইনি বামপদ দ্বারা মহিষাসুরকে আক্রমণ পূর্বক শূল দ্বারা তাকে বিদীর্ণ করে অবস্থিতা । বস্তুত ইনি দুর্গামূর্তি ।
এঁনার পূজো গৃহস্থ ও সাধক উভয়েই করতে পারেন ।
রক্ষাকালী মাতা
দারুকাসুর মর্দিনী কালী মাতা
লিঙ্গ পুরান এ এই কালী মায়ের কথা বলা আছে । ইনি মহাদেবের শরীরে প্রবেশ পূর্বক মহাদবের কন্ঠে স্থিত গরলে নিজ তনু কৃষ্ণ বর্ণ করেছেন । মহাদেবের ন্যায় ইনি ত্রিশূল ধারিনী , শ্রীকরে সর্প বলয় যুক্তা । লিঙ্গ পুরান মতে ইনি দারুক নামক এক অসুরকে বধ করেছিলেন । এনাকে শ্রী কালী ও বলা হয় ।
অন্তিমে সকলে আমরা সেই আদ্যাশক্তি মা কালীকে বন্দনা করি । তিনি আমাদের সকলের মধ্যে শক্তিরুপে জেগে উঠুন । তাঁর শক্তিতেই যেন আমরা বলবান হই । কোন ক্লীবতা যেনো আমদের স্পর্শ করতে না পারে । অন্তিমে যেনো সেই জগত জননীর কোলে ফিরে যেতে পারি ।
জাগো , জাগো, জাগো জননী ,
তুমি না জাগিলে শ্যামা
আর তো কেউ জাগে না মা ,
তুমি না নাচিলে মাগো
নাচিবে না ধমনী ।
দীপাবলি ও আলোর উৎসব
শ্রী শ্রী কালী মা সাক্ষাৎ ব্রহ্মময়ী । তিনি আমাদের অবিদ্যা রুপিনী অন্ধকার কে নাশ করে আমাদের জ্ঞান দেন , চেতনা দেন । তাঁর ত্রিনয়ন চন্দ্র , সূর্য , অগ্নি । তার লোমকূপ সকল কোটি কোটি প্রতীপ্ত তারকা । তার আবির্ভাবে অন্ধকার ময় অবিদ্যা , আসুরিক শক্তি নাশ হয়ে যায় । তাই কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় আমরা শত শত প্রদীপের আলোকমালায় সেই জগত মাতাকে বরন করে নেই । প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আমাদের অন্ধকার অবিদ্যার জাল থেকে মুক্ত করে দেন ।
দেশপ্রেম ও মা কালী
জগতজননী মা ও ভারতমাতা অভিন্না । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ‘আনন্দমঠ’ তিনি ভারতমাতা ও মহিষমর্দিনী দুর্গাকে এক বলে বর্ণনা করেছেন ।
“ বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি গড়ি মন্দিরে মন্দিরে ।
ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরনধারিনী
কমলা কমল – দলবিহারিণী ”
“ – “ এই যে মা হইবেন । দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত ,- তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত , পদতলে শত্রু বিমর্দিত , পদাশ্রিত , বীরকেশরী , শত্রু নিপীড়নে নিযুক্ত । দিগভুজা ” (আনন্দমঠ / একাদশ পরিচ্ছেদ )
পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয় বিপ্লবীরা ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যখন প্রস্তুত হতেন – প্রথমেই নিতে হত জগত জননী কালী মায়ের আশীর্বাদ । কথিত আছে বিপ্লবী রা কালীঘাট বা তারাপীঠ গিয়ে দেবীর চরণ ছুয়ে দেশমাতৃকার উদ্ধার এর জন্য কঠোর সংকল্প নিতেন ।
ফাঁসীর আগে যখন ক্ষুদিরাম কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল “ অন্তিম ইচ্ছা কি? ”ক্ষুদিরাম জানিয়েছিলেন , তিনি দেবী চতুর্ভুজার প্রসাদ খেতে চান । ( আঠেরোর দীপ্তশিখা ক্ষুদিরাম/ লেখক- সুশান্তকুমার সাহিত্যরত্ন)