ঈশ্বর কণা বা God Particle বর্তমান পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে বহুচর্চিত একটি বিষয় । বিষয়টির সাথে সরাসরি প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণার কোনও মিল না থাকলেও অধ্যাত্মবাদী ঈশ্বরবিশ্বাসী , বিশেষতঃ বেদান্ত দর্শনে বিশ্বাসী মানুষ God Particle এর ধারণার মধ্যে খুঁজে পেতে পারেন ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কিত ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শনের তত্ত্বগত সমর্থন ।
আমেরিকায় বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ যখন ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শনের বিজয়পতাকা ওড়াচ্ছেন তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে এসেছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী টেসলা ( Sir Nikola Tesla ) । টেসলার সাথে স্বামীজির আলোচনা হয় ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শনের ‘আকাশ ’ ও ‘প্রাণ ’তত্ত্ব সম্পর্কে । সাংখ্য দর্শনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ একজায়গায় বলেছিলেন , ‘‘ আমরা যাহাদিগকে জড় ও শক্তি বলি ... ইহাদের অতি সূক্ষ্ম অবস্থাকেই প্রচীন দার্শনিকগণ ‘প্রাণ’ ও ‘আকাশ’ নামে অভিহিত করিয়াছেন। .....আজকাল ‘ইথার’ বলিতে যাহা বুঝায়, ইহা কতকটা তাহারই মতো, যদিও সম্পূর্ণ এক নয়। আকাশই আদিভূত- উহা হইতেই সমুদয় স্থূল বস্তু উৎপন্ন হইয়াছে আর উহার সঙ্গে ‘প্রাণ’ নামে আর একটি বস্তু থাকে-ক্রমশ আমরা দেখিব, উহা কি। ... এই প্রাণ ও আকাশ ... নানা রূপে মিলিত হইয়া এই-সমুদয় স্থূল প্রপঞ্চ গঠন করিয়াছে, অবশেষে কল্পান্তে ঐগুলি লয়প্রাপ্ত হইয়া আকাশ ও প্রাণের অব্যক্তরূপে প্রত্যাবর্তন করে। জগতের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে সৃষ্টিবর্ণনাত্মক একটি সূক্ত আছে ( ঋগ্বেদ, ১০। ১২৯ /নাসদীয় সূক্ত ) সেটি অতিশয় কবিত্বপূর্ণঃ ‘যখন সৎ ও ছিল না, অসৎ ও ছিল না, অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল, তখন কি ছিল ?’ আর ইহার উত্তর দেওয়া হইয়াছে : ‘ইনি-সেই অনাদি অনন্ত পুরুষ-গতিশূন্য বা নিশ্চেষ্টভাবে ছিলেন।’
প্রাণ ও আকাশ তখন সেই অনন্ত পুরূষে সুপ্তভাবে ছিল, কিন্তু কোনরূপ ব্যক্ত প্রপঞ্চ ছিল না । এই অবস্থাকে ‘অব্যক্ত’ বলে । উহার ঠিক শব্দার্থ স্পন্দন-রহিত বা অপ্রকাশিত। একটি নূতন কল্পের আদিতে এই অব্যক্ত স্পন্দিত হইতে থাকে, আর প্রাণ আকাশের উপর ক্রমাগত আঘাতের পর আঘাত করে, আকাশ ঘনীভূত হইতে থাকে, আর ক্রমে ... পরমাণু গঠিত হয়। এইগুলি পরে আরও ঘনীভূত হইয়া দ্ব্যণুকাদিতে পরিণত হয় এবং সর্বশেষে প্রাকৃতিক প্রত্যেক পদার্থ যে যে উপাদানে নির্মিত, সেই-সকল বিভিন্ন স্থূল ভূতে পরিণত হয়। ... ’’ [ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা / ২য় খণ্ড ]
অর্থাৎ প্রাচীন ভারতীয় ঋষিরা ‘ আকাশ ’ বলতে একটি unified field ( ক্ষেত্র ) বুঝিয়েছেন যা সকল জড় পদার্থের উৎস ।
‘ আকাশের ’উপর প্রাণ নামক আদি শক্তির ক্রিয়ায় এই বিচিত্র ব্রহ্মাণ্ডের উদ্ভব । পরবর্তীকালে নিশ্চল মহাকালের শরীরের উপর নৃত্যরতা কালীর প্রতীকী ধারণার উদ্ভবের পিছনেও সম্ভবতঃ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের এই আধ্যাত্মিক সৃষ্টিতত্ত্বের প্রভাব ছিল । যাইহোক , এই প্রাণ ও আকাশ অব্যক্ত অবস্থায় একীভূত , অর্থাৎ এরা স্বরূপতঃ অভিন্ন । সকল জড় পদার্থ ও শক্তির উৎস এই আকাশ ও প্রাণের স্বরূপতঃ অভিন্নতার তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা দাবী করে জড় জাগতিক সবকিছুই সকল পদার্থ ও শক্তিই স্বরূপতঃ অভিন্ন । এরা একেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ । উপনিষদ শিক্ষা দেয় –
‘... তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দুরে তদ্বন্তিকে।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।।
যস্তু সর্বাণি ভূতানি আত্নন্যেবানুপশ্যতি।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।।
যস্মিন্ে সর্বাণি ভূতানি আত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ।
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ।।’
অর্থাৎ , তিনি সচল, তিনি স্থির; তিনি দূরে, তিনি নিকটে; তিনি এই সকলের ভিতরে, আবার তিনি এই সকলের বাহিরে। যিনি আত্মার মধ্যে সর্বভূতকে দর্শন করেন, আবার সর্বভূতে আত্মাকে দর্শন করেন, তিনি কিছু গোপন করিতে ইচ্ছা করেন না। যে অবস্থায় জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে সর্বভূত আত্মস্বরূপ হইয়া যায়, সেই একত্বদর্শী পুরুষের সেই অবস্থায় শোক বা মোহের বিষয়
থাকেনা ।
আবার উপনিষদের ঋষি বলেছেন --
'অগ্নির্যথৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব।
একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ।।'
( কঠ উপনিষদ, ২/২/৯)
অর্থাৎ , যেমন এক অগ্নি জগতে প্রবিষ্ট হয়ে নানারূপে প্রকাশিত হয়েছেন, তদ্রূপ সেই সর্বভূতের অন্তরাত্মা এক ব্রহ্ম নানারূপে প্রকাশিত হচ্ছেন , আবার তিনি জগতের বাইরেও আছেন । এভাবেই আমাদের প্রাচীন ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শন বহুত্বের মধ্যে একত্বের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছে ।
বিজ্ঞানী টেসলাকে স্বামীজি বলেন জাগতিক পদার্থ ও শক্তিসমূহের এই অভিন্নতার তত্ত্বটি বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রমাণ করা যায় কিনা তা দেখতে । অবশেষে 1905 সালে অর্থাৎ স্বামীজির দেহত্যাগের তিন বছরের মাথায় বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আবিষ্কার প্রমাণ করে দিল এই অভিন্নতার তত্ত্বকে । পদার্থ বিজ্ঞানে যুক্ত হল একটি নতুন সমীকরণ –
E=m c^2
এই সমীকরণ অনুযায়ী জড় ও শক্তি পরস্পর রূপান্তরযোগ্য , অর্থাৎ জড়পদার্থ এবং শক্তি স্বরূপতঃ অভিন্ন । জড়কে শক্তিতে এবং শক্তিকে ভরযুক্ত কণা বা জড়ে রূপান্তরিত করা সম্ভব – একথা তাত্ত্বিক ভাবে পদার্থ বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হল । আইনস্টাইন বললেন , ‘‘ Matter is nothing but frozen energy.’’ । এরপর চলল শক্তিকণা ( energy packet) কিভাবে ভরযুক্ত হয়ে জড়কণায় পরিণত হয় – এ নিয়ে অনুসন্ধান ।
1964 - 65 সালে বিজ্ঞানী পিটার হিগস বললেন হিগস ক্ষেত্রের (Higgs field) কথা , যে ক্ষেত্রে কোনও শক্তিকণা ( energy packet) প্রবেশ করলে সেটি বস্তুকণায় পরিণত হবে । এই হিগস ক্ষেত্র আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শনের ‘আকাশ’ নামক সেই আদি ক্ষেত্রের (field) কথা যার উপর ‘প্রাণ’ নামক আদি শক্তির ক্রিয়ায় জড়ের উৎপত্তি । এ বিষয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি ।
যাইহোক এই হিগস ক্ষেত্র (Higgs field) সৃষ্টির জন্যে দায়ী হল হিগস-বোসন কণা , যার পোশাকি নাম ঈশ্বরকণা (God Particle) । ইলেকট্রন কণা যেমন তড়িৎ ক্ষেত্র সৃষ্টি করে তেমনি হিগস-বোসন কণা উৎপন্ন করে হিগস ক্ষেত্র । হিগস-বোসন কণা এবং তা থেকে সৃষ্টি হওয়া হিগস ক্ষেত্রের সাথে বিজ্ঞানী পিটার হিগসের সম্পর্কের কথা তো আগেই বলেছি । কিন্তু হিগসের সাথে ‘বোসন’ শব্দটি যুক্ত হল কেন ? আসলে এই ‘বোসন’ শব্দটি এসেছে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বোসের পদবী ‘বোস’ থেকে। 1920-24 সালে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বোস ( যাঁর পদধূলিধন্য আমাদের এই ঢাকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ) ফোটনের মতো সূক্ষ্ম কণাদের গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে আবিষ্কার করেন নতুন statistical theory । এই আবিষ্কারের সাথে যুক্ত ছিলেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও । এই নতুন statistics পদার্থ বিজ্ঞানে পরিচিত হয় ‘ Bose-Einstein statistics’ বা ‘ B-E statistics’ নামে । যেসব কণা B-E statistics মেনে চলে তাদেরকে পদার্থ বিজ্ঞানে ‘বোসন’ বলা হয় । হিগস ক্ষেত্র উৎপাদনকারী কণাগুলি এই বোসন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত । তাই এদেরকে ‘হিগস-বোসন কণা’ নাম দেওয়া হয়েছে ।
বোসন কণারা আবার দুই ধরণের হয় -- Force carrier gauge Boson ( যেমন photon , gluon ইত্যাদি ) , এবং ভরসৃষ্টিকারী Higgs-Boson । এই হিগস-বোসন কণা free space-এ যে হিগস ক্ষেত্র (Higgs field) উৎপন্ন করে তারই সংস্পর্শে এসে শক্তি কণা রূপান্তরিত হয় ভরযুক্ত জড়কণায় ।
তাত্ত্বিকভাবে এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হবার পর এবার হিগস-বোসনকে হাতেনাতে ধরার পালা । Big-Bang বা সৃষ্টির আদিলগ্নের বিস্ফোরণে যে হিগস-বোসন কণারা হিগস ক্ষেত্র উৎপাদনের মাধ্যমে ভর সৃষ্টি করে শক্তি থেকে জড় পদার্থের জন্ম দিয়েছে তাকে ধরার জন্যে Big-Bang এর অনুরূপ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন । এরজন্য মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে বসানো হল Large Hadron Collider ( LHC ) যন্ত্র । এই যন্ত্রে ব্যবহৃত হয়েছে সহস্রাধিক উচ্চ ক্ষমতাশালী তড়িচ্চুম্বক , যা প্রোটন সহ বিভিন্ন আধানযুক্ত কণাকে একটি চক্রাকার পথের সুড়ঙ্গে পরিচালিত করতে পারে। সাতাশ টন ভরের একেকটি চুম্বককে পরম শূন্য ( মাইনাস 273 ডিগ্রী সেলসিয়াস ) উষ্ণতার কাছাকাছি রাখতে ব্যবহৃত হল প্রায় দশহাজার টন তরল নাইট্রোজেন ও একশকুড়ি টন তরল হিলিয়াম । সমগ্র প্রক্রিয়াটির সাথে যুক্ত হলেন একশটি দেশের প্রায় দশহাজার বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ । LHC থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণের জন্যে তেত্রিশটি দেশের একশবাহান্নটি কম্পিউটার কেন্দ্রের সাহায্যে প্রায় একলাখ চল্লিশ হাজার ইউনিট প্রসেসর দিয়ে বানানো হল পৃথিবীর বৃহত্তম কম্পিউটার ।
আয়োজন সম্পূর্ণ হলে শুরু হল গবেষণার কাজ । কিন্তু LHC চালু হবার নয় দিনের মাথায় ঘটে গেল বিপর্যয় । বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে আবেষ্টনী ভেদ করে বেরিয়ে গেল প্রায় ছয়হাজার টন হিলিয়াম । ফলে দ্রুত উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং চৌম্বকক্ষেত্রের দ্রুত হ্রাস হওয়ায় বিপুল পরিমাণ শক্তি মুক্ত করে ঘটল বিস্ফোরণ । সেই বিস্ফোরণে বেশ কয়েকটি ভারী চুম্বক মেঝে থেকে উপড়ে গিয়ে দূরে আছড়ে পড়ল । হিলিয়ামের প্রভাবে LHC এর টানেলটি এত শীতল হয়ে গেল যে কয়েক সপ্তাহ সেখানে কর্মীরা ঢুকতেই পারলেননা ।
অবশেষে প্রয়োজনীয় মেরামতির পর পুনরায় শুরু হল গবেষণার কাজ । এর মধ্যে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর । LHC যন্ত্রের সাহায্যে প্রচণ্ড বেগে গতিশীল 7 to 8 TeV শক্তিসম্পন্ন দুটি বিপরীতমুখী প্রোটন কণার স্রোতের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটিয়ে প্রমাণিত হল হিগস-বোসন কণার অস্তিত্ব । 1984 সালে শুরু হওয়া বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার সাফল্য মিলল 2012 সালের 4 জুলাই ।
কিন্তু হিগস-বোসন কণা বা ঈশ্বর কণা এতই ক্ষণস্থায়ী যে কণাটির উদ্ভব থেকে বিলুপ্তি পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র আয়ুষ্কালের মধ্যে যন্ত্রও তাকে প্রত্যক্ষ করতে পারেনা । তাহলে এই কণা কিভাবে সনাক্ত করলেন বিজ্ঞানীরা ? আসলে প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষের এই পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন মহাবিশ্বের জন্মলগ্নের 〖10〗^(-6) সেকেন্ড ( এক সেকেন্ডের দশলক্ষ ভাগের একভাগ ) সময় পরের অবস্থাটিকে । এই অবস্থায় আবির্ভূত হয়েছে ঈশ্বর কণা এবং মুহূর্তের মধ্যে লুপ্ত হয়েছে নতুন কণার জন্ম দিয়ে । ঈশ্বর কণা লুপ্ত হবার মুহূর্তে যে নতুন কণাগুলি সৃষ্টি করতে পারে তাদেরকে সনাক্ত করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা এবং তা থেকেই নিশ্চিতভাবে সিদ্ধান্ত করা গেছে যে পরীক্ষাগারে Big Bang বা মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্তের অনুরূপ কৃত্রিম ঐ অবস্থায় আবির্ভূত হয়েছিল ঈশ্বর-কণা ।
-------------------------------- সমাপ্ত -----------------
লেখক – তাপস ঘোষ ( শিক্ষক , পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ ) ( www.facebook.com/tapas.ghosh.90 )
সর্বস্বত্ব লেখক দ্বারা সংরক্ষিত, লেখকের বিনা অনুমতিতে অন্যত্র প্রকাশ বেআইনী ।
সর্বস্বত্ব লেখক দ্বারা সংরক্ষিত, লেখকের বিনা অনুমতিতে অন্যত্র প্রকাশ বেআইনী ।
No comments:
Post a Comment